উন্নয়নে ‘উইপোকা’ ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি

আব্দুল বায়েস

এক. শৈশবের কথা। আমার মা আচার বানিয়ে বয়ামে পুরে রাখতেন। ওই আচার দেখলে জিভেয় জল এসে যেত, কিন্তু বিনা অনুমতিতে ভোগ নিষিদ্ধ ছিল। চুরিচামারি করে বয়ামে আঙুল ঢুকিয়েছি তো তর্জনীটা মুচড়ে দিয়ে বলতেন, আর খাবি চুরি করে? জানিস না চুরি করলে গুনাহ হয়? কিন্তু চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। একদিন বয়ামের নিচে ফুটো করে আঙুল দিয়ে আচার চেখে খেলাম। এমনি করে বেশ কদিন চলল। বাইরে থেকে দেখলে বয়ামটা আচারে পূর্ণ, কিন্তু ভেতরে ক্ষরণ হচ্ছিল। অবশেষে একদিন মা দেখলেন বয়ামের নিচের দিক খালি, কিন্তু উপরের দিকে আচার আছে ঠিকই। উইপোকা যখন বাঁশ বা কাঠ কাটে, তখন ঠিক এমন অবস্থা হয়। একটা সময় পর্যন্ত মনেই হয় না যে ভেতরে গলদ আছে। অথচ গলদ গভীর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছেন, তার সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় উইপোকা বাসা বেঁধেছে, যা উন্নয়নকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর তাই বোধহয় প্রকল্প শেষ হওয়ার সময় বাড়ছে এবং বাড়ছে, প্রতি ইউনিট রাস্তা নির্মাণে সবচেয়ে বেশি খরচ বাংলাদেশে, অহরহ নিম্নমানের প্রকল্প গ্রহণের তাগিদ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জালে আবদ্ধ উন্নয়ন চাকা, ব্যবসাবান্ধব উন্নতি সূচকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে প্রভৃতি। সম্ভবত তিনি এটাও বুঝতে পেরেছেন, স্খলিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাম্প্রতিক উদাহরণ ফিলিপাইন নামে দেশটি একদা যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম কাতারে ছিল, অথচ পিছলে পড়ে আজ অনেক পিছিয়ে। মনে রাখতে হবে, মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে পরিমাণগত প্রবৃদ্ধি অর্জন একটা দরকারি শর্ত মাত্র। যথেষ্ট শর্ত হচ্ছে প্রবৃদ্ধির মান, যা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে।

দুই. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বেশকিছু মন্তব্য করেছেন, যা আমার মতো একজন অধ্যাপকের মনে রেখাপাত করেছে। অবশ্য এমন নয়, যে বিষয়টির ওপর তিনি কথা বলেছেন তা একেবারেই নতুন। দাতা সংস্থা, সুশীল সমাজ, সমাজবিজ্ঞানীরা, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারেও এ কথা বলা আছে ভিন্ন তালে, ভিন্ন লয়ে। কিন্তু যে অনন্য উপমায় তিনি সমস্যাটাকে প্রমূর্ত উপস্থাপন করলেন, তা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন এবং আমি যতটুকু তার কথা থেকে বুঝতে পেরেছি, ‘উইপোকা আমাদের উন্নয়নকে খেয়ে ফেলছে; দুর্নীতি না হলে আমরা আরো অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম; অস উপার্জনকারীর দাপটে সমাজে স মানুষ হতাশ। আর তাই অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী ও দুর্নীতিবাজ যদি নিজ দলেরও হয়, এক রতি ছাড় দেয়া হবে না। মোটকথা, () দুর্নীতি তথা অপকর্ম না হলে আমরা এতদিন আর্থসামাজিক উন্নয়নের আরো বেশি উঁচু ধাপে থাকতে পারতাম এবং () এ সমাজে খারাপ মানুষ ভালো মানুষকে খেদিয়ে চলেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

অথচ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।

তিন. প্রধানমন্ত্রীর যে-ই কথা, সে-ই কাজহাতেনাতে তা প্রমাণ পেল দেশবাসীঅবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি অপকর্মে জড়িত পালের কিছু গোদা এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে। তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক। সপ্তাহখানেক ধরে টক অব দ্য টাউন সাঁড়াশি অভিযানেগডফাদার আরগডব্রাদারদের আস্তানা থেকে নগদ কোটি কোটি টাকা, কয়েকশ কোটি টাকার এফডিআর, বিপুল পরিমাণ সোনাদানা, অস্ত্রশস্ত্রসহ বিদেশী দামি দামি মদ ও ইয়াবা আটক করা হয়েছে। শুধু ঢাকা শহরে ৬০টি ক্যাসিনোয় প্রতি রাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হতো। অনুমান করি, তার তিন ভাগের এক ভাগও যদি মাফিয়াদের কাছে ট্যাক্স হিসেবে যায়, তাহলেপ্রাপ্তির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এ অর্থ মাফিয়া ট্যাক্স হিসেবে দেয়গুরু হিসেবে থাকা বিভিন্নজনকে। সাদা অর্থনীতিতে যেমন প্রবৃদ্ধির ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট থাকে, তেমনি কালো অর্থনীতিতে থাকে ট্রিকলআপ ইফেক্ট।

চার. মোটা দাগে একটা দেশে দুই ধরনের অর্থনীতি থাকে: ফরমাল ও ইনফরমাল। প্রথমটি দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় সংগঠিত খাত। দ্বিতীয়টি আইনের আওতায় থাকতেও পারে তবে সংগঠিত নয়। তবে সাধারণ আলোচনার বাইরেও আরেকটা অর্থনীতির অস্তিত্ব আছে, যা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন কালো, আন্ডারগ্রাউন্ড, গ্রে, ইকোনমি ইত্যাদি। এ অর্থনীতি দেশের প্রচলিত আইনের ধার ধারে না, কর দেয় না, অনুমতি নেয় না, ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন খুব কম। যেমন বাংলাদেশের ক্যাসিনো ব্যবসা, কালোবাজারি, চোরাচালানি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড আন্ডারগ্রাউন্ড অথবা কালো অর্থনীতির অংশ। আমার ব্যক্তিগত হিসাব, বাংলাদেশে কালো অর্থনীতির আকার বছরে কয়েক লাখ কোটি টাকা। ধরা যাক, আমাদের জিডিপি ৩০ লাখ কোটি টাকার হয়, তাহলে কালো অর্থনীতির আকার প্রায় ৫-৬ লাখ কোটি টাকা বা বর্তমান বাজারদরে একটা বার্ষিক বাজেটের সমান।

");

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন