অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি

অর্থনীতির জন্য সতর্কবার্তা

দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চলছে রফতানি পণ্য ও বাজারে বৈচিত্র্য আনার। কিন্তু এ প্রয়াসের তেমন সুফল মেলেনি। ঘুরেফিরে আমাদের রফতানি আটটি পণ্যে সীমাবদ্ধ। মোট রফতানি আয়ের ৯৬ শতাংশই আসে এসব পণ্য থেকেই। রফতানি তালিকায় রয়েছে পাঁচ হাজার পণ্য। কিন্তু ওই আটটি ছাড়া অবশিষ্ট পণ্যগুলো কদাচি কখন কোথায় রফতানি হয় জানাও যায় না। আবার আটটি পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাকের প্রভাব সর্বাধিক। রফতানি আয়ে পোশাক শিল্পের অবদান ৮০ শতাংশেরও বেশি। আবার পোশাক খাতের মধ্যেও বৈচিত্র্য সংকট রয়েছে। ঘুরেফিরে কম দামের গতানুগতিক পণ্যের গণ্ডিতে ঘুরপাক খাচ্ছেএসব পণ্যের দরও খুবই কম। একক বাজার ও একক পণ্যের ওপর অতি নির্ভরশীলতার অর্থ হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান উস বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। কূটনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কোনো কারণে অতি নির্ভরশীল বাজার হারালে রফতানি খাত পুরোটাতে ধস নামবে। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে সংস্কারের চাপ। একক পণ্যনির্ভরতা শুধু রফতানি খাতকে নয়, দেশের সম্পূর্ণ অর্থনীতিকেই ঝুঁকিতে ফেলেছে। যেকোনো কারণে পোশাক খাত মার খেলে ৪০ লাখ শ্রমিকসহ এ খাত ঘিরে পরিচালিত ব্যাংক, বীমাসহ অন্যান্য সেবা ও শিল্প খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে পণ্যে বৈচিত্র্য আনা দরকার। নতুন নতুন বাজারও দরকার। অথচ এক্ষেত্রে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। শ্রমঘন ও রফতানি আয়ের উস হওয়ায় পোশাক খাতে আমাদের সবসময় নজর রাখতে হবে। কী কী পদক্ষেপ নিলে পোশাক খাত আগামী দিনে আরো উন্নতি করবে, তা নিয়ে গবেষণা করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে নতুন বাজার অনুসন্ধান এ খাতের উন্নতিতে সহায়ক হবে বৈকি।

শুধু তৈরি পোশাক খাতকে গুরুত্ব দিলে হবে না। এতে রফতানি আয়ে আরো ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। হিমায়িত খাদ্য এবং মাছ থেকে শুরু করে চামড়া ও প্লাস্টিকের মতো পণ্য উপাদনে নজরদারি বাড়াতে হবে। চামড়া খাত নিয়ে যে বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা যেন ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। কেন চামড়া খাতের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে না, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি-রফতানির লিড টাইম নিশ্চিত করা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো খুবই জরুরি। বিষয়টির দিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়াটাও দরকার। পাট ও পাটজাত পণ্য নিয়েও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে রফতানি আয় বেড়েছে। তবে এতে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। রফতানি খাতকে আরো সুসংহত করতে নীতি ও নগদ প্রণোদনায় বিষয়টি সরকারের ভাবার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, রফতানি খাতে যত বেশি বৈচিত্র্য আনা যাবে, ততই বাড়বে আয়ও। রফতানি খাতে বহুমুখী শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি খাতে উদ্যোগ আশানুরূপ না হওয়ায় এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে পণ্যের বহুমুখীকরণ হচ্ছে না। এতে রফতানি বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ছে দেশ।

রফতানি বাণিজ্য টেকসই করতে হলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সরকারি সহায়তা আরো বাড়ানো অত্যাবশ্যক। আর রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরই বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। রফতানিকারকরা একই ধরনের ব্যবসা না করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা করলে এর সমাধান হবে। ব্যবসায়ীরা তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে ব্যবহার করতে পারলে তারা অবশ্যই লাভবান হবেন। বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনো নীতিসহায়তার বাইরে রয়ে গেছেন চার হাজার উদ্যোক্তা। এ কারণে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রফতানি ঈপ্সিত গতিতে এগোচ্ছে না। রফতানিতে দীর্ঘদিনের সংকট দূর করতে হলে সব রফতানি খাতকে সমান সুযোগ দিতে হবে। যেমন শুল্কমুক্ত কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি সুবিধা। রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়াসহ সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কারখানায় অটোমেশনেও পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। সরকারের নীতিসহায়তাও প্রয়োজন। কেননা ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতনে তারা আমাদের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো করছে। এখানে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাচ্ছে। প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হারকে বিবেচনায় না এনে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক বিনিময় হার বজায় রাখার বিপদ সম্পর্কে আগেই সতর্ক করেছিল আইএমএফ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে পরামর্শ আমলে নেয়া হয়নি। রফতানিকারকরা ডলারের দাম কমিয়ে রাখায় স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরের পর তাদের রফতানি পণ্যের প্রকৃত দাম পাচ্ছেন না। এতে অনেকের দেশে অপ্রত্যাবাসিত রফতানি আয় বেড়ে যাচ্ছে। নানা অজুহাতে রফতানি মূল্য দেশের বাইরে রেখে দেয়া হচ্ছে। কয়েক বছরের রফতানি চিত্রে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বাংলাদেশের হাতে বড় অস্ত্র হতে পারে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা। আমাদের অন্য রফতানি খাতগুলো আগে থেকেই রুগ্ণ হয়ে আছে। একটি মাত্র খাত তৈরি পোশাক শিল্প, যা আমাদের অর্থনীতিকে প্রাণশক্তি দিয়েছে। এ শিল্প রুগ্ণ হলে আমাদের অর্থনীতির চলত্শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। এছাড়া বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে একটি মন্থর ভাব চলছে। বিশেষ করে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্থর অবস্থা চলছে। এ মন্থর অবস্থা রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করছে। আগামীতে এ মন্থরগতি প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন