আইনটি যেন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বিচারে বাধা না হয়

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর দশম জাতীয় সংসদে পাসকৃত এবং ওই বছর ১৪ নভেম্বর সরকারি গেজেটে প্রকাশিত সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গেজেট জারি করেছে। উল্লেখ্য, গত বছর ১৪ নভেম্বর জারিকৃত গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা যে তারিখ নির্ধারণ করবে, সে তারিখে আইনটি কার্যকর হবে। আইনটি কার্যকর হওয়ার ফলে এর আগে প্রচলিত Public Servants (Retirement) Act 1974, Services (Reorganization and Conditions) Act 1975, Government Servants (Special Provisions) Ordinance 1979, Public Employees Discipline (Punctual Attendance) Ordinance 1982, Public Servants (Dismissal on Conviction) Ordinance ১৯৮৫ ও উদ্বৃত্ত সরকারি কর্মচারী আত্তীকরণ আইন ২০১৬ বাতিল হয়েছে বলে গণ্য হবে। ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-তে মোট ৬২টি ধারা রয়েছে।

আমাদের সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সংসদ কর্তৃক আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এর আগে কোনো সরকার তা করেনি। সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন না থাকায় এর আগের সরকারগুলো, বিশেষ করে দলীয় সরকারগুলো সরকারি কর্মচারীদের দলীয়করণের উদ্দেশ্যে নিয়োগ ও পদোন্নতির বিধি-বিধানাবলি ব্যবহার করেছে। নিজ নিজ দলের আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি ও পদায়নের সুবিধার্থে তারা ক্ষমতায় এসে বিদ্যমান বিধিমালায় পরিবর্তন এনেছে অথবা নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। তাই দেরিতে হলেও আইনটি প্রণয়নের জন্য ক্ষমতসীন আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারে।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে প্রশাসনকে নির্দলীয় ও গণমুখীর অঙ্গীকার করেছিল। মেনিফেস্টোতে বলা হয়, চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির মাপকাঠি হবে মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। প্রশাসন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা হবে। প্রশাসনে গতিশীলতা আনয়নে এবং জনসেবার মানোন্নয়নে একটি কার্যকর সিভিল সার্ভিসের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের কথা বলতে শুরু করে। দেশের শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি কার্যকর সিভিল সার্ভিসের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে শক্তিশালী সিভিল সার্ভিস গঠনের ওপর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক (২০১১-১৫) পরিকল্পনায় জোর দেয়া হয়। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রস্তাবিত আইনটি সম্পর্কে মতৈক্যের অভাব এবং এটির বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারি প্রভাবশালী কর্মচারীদের বিরোধের কারণে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট থেকে সরে এসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়।

সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’-এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো () সরকার, সরকারি গেজেটে আদেশ দ্বারা, প্রজাতন্ত্রের যেকোনো কর্ম বা কর্মবিভাগ সৃজন, সংযুক্তীকরণ, একীকরণ বা বিলুপ্তীকরণসহ অন্য যেকোনোভাবে পুনর্গঠন করতে পারবে।

() সরকারি কর্মচারীদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণসাপেক্ষে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আইনানুগ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে। () এ আইনের আওতাভুক্ত কোনো কর্ম বা কর্মবিভাগে সরাসরি জনবল নিয়োগের ভিত্তি হবে মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা।

বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না। () কোনো স্থায়ী সরকারি কর্মচারীকে সততা, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ ও সন্তোষজনক চাকরি বিবেচনাক্রমে পদোন্নতি দিতে হবে।

() সরকার, সরকারি গেজেটে আদেশ দ্বারা কোনো সরকারি কর্মচারীর বা সব সরকারি কর্মচারীর বা সরকারি কর্মচারীদের কোনো অংশের জন্য বেতন, ভাতা, বেতনের গ্রেড বা স্কেল, অন্যান্য সুবিধা ও প্রাপ্যতা বা অবসর সুবিধা সম্পর্কিত শর্তাদি নির্ধারণ করতে পারবে।

() সরকার বা, ক্ষেত্রমতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সরকারি কর্মচারী ও তার পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে শিক্ষা, চিকিসা, আবাসন ও অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ে কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

() সরকার, সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিতকরণে কর্মচারীদের বিশেষ সাফল্য, উদ্যোগ, উদ্ভাবনী প্রয়াস বা অবদানের জন্য প্রণোদনা, পুরস্কার, স্বীকৃতি বা সম্মান প্রদান করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

() সরকার, জনপ্রশাসনের সব পর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিতকল্পে, সরকারি কাজ সম্পাদনের নীতি, শুদ্ধাচার চর্চা এবং কর্মচারী কর্তৃক অনুসরণীয় নৈতিকতার মানদণ্ড অনুসরণের প্রক্রিয়া ও কৌশল প্রণয়ন করবে।

() এ আইনের বিধানাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে সরকারি কর্মচারীর আচরণ এবং শৃঙ্খলাসংশ্লিষ্ট বিষয় ও শর্তাদি সংশ্লিষ্ট বিধি ও সরকার কর্তৃক সময় সময় জারিকৃত নির্বাহী আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হবে।

() কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।

() কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো আদালতে ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনি কার্যধারা বিচারাধীন থাকলে বিচারাধীন এক বা একাধিক অভিযোগের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা রুজু বা নিষ্পত্তির ব্যাপারে কোনো বাধা থাকবে না।

() কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড বা এক বছরের অধিক মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে দণ্ড আরোপের রায় বা আদেশ প্রদানের তারিখ হতে তাত্ক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হবেন। তবে কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধে এক বছরের বেশি দণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি যদি তাকে অব্যাহতি দেন, সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হবেন।

() চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে যেকোনো সময় একজন সরকারি কর্মচারী অবসর গ্রহণ করতে পারবেন এবং চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, সরকার এমন কোনো সরকারি কর্মচারীকে কোনোরূপ কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরি হতে অবসর প্রদান করতে পারবে।

() রাষ্ট্রপতি, জনস্বার্থে, কোনো কর্মচারীকে চাকরি হতে অবসর গ্রহণের পর সরকারি চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করতে পারবেন।

() সরকারি কর্মচারীর অবসরে গমন বা অন্য কোনো উপায়ে চাকরির পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রে সুবিধাদির প্রাপ্যতা, শর্তাদি ও অন্যান্য বিষয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। তবে অবসর গ্রহণের পর কোনো ব্যক্তি গুরুতর অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত বা কোনো গুরুতর অপরাধের দোষে দোষী সাব্যস্ত হলে, কারণ দর্শানোর যুক্তিসংগত সুযোগ প্রদান করে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তার অবসর সুবিধা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাতিল, স্থগিত বা প্রত্যাহার করতে পারবে।

আইনটির একটি ধারা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে আইনটির ৪১ ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে, এ ধারা কার্যকর করার ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়বে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র সংকুচিত হবে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি বলেছে, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতারে পূর্বানুমতি গ্রহণের যে বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে, তা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের সততা, স্বচ্ছতা, উন্নততর পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন নিশ্চিতের পরিপন্থী।

এখানে যে বিষয়টি স্মরণে রাখা প্রয়োজন, তা হলো সরকারি কর্মচারীরা নীতিনির্ধারণী বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে সহায়তা করেন এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে থাকেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসরণ করে থাকেন। তাই এর অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ার আগে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হলে তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করে এর সত্যতা খুঁজে পেলে তাকে গ্রেফতারের অনুমতি দেবে। এসব বিবেচনায় কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতারে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণের বিধানটি যুক্তিসংগত হয়েছে বলে মনে হয়।

সবশেষে বলতে চাই, দেশের দুর্নীতি চক্রে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। বিশেষ করে একটানা ১০ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারি কর্মচারীরা ছাত্রজীবনে দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং/অথবা নিজেদের চাকরি রক্ষা এবং পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিংয়ের আশায় ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হওয়ায় তারা দুর্নীতি করতেও ভয় পান না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আটক একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক জি কে শামীমের প্রাথমিক স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক সাবেক প্রধান প্রকৌশলী তার কাছ থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এ ধরনের অনেক উদাহরণ রয়েছে। তাই সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে যেন সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতারে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণের বিধানটি দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীদের ঢাল হয়ে না দাঁড়ায়।

 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক সচিব

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন