একটি বালিকা ও একজন প্রেসিডেন্ট

চৌধুরী মুফাদ আহমদ

গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যখন রাস্তায় নেমে এসেছিল, প্রায় একই সময় সুইডেনের এক ১৫ বছরের বালিকা একদিন স্কুলে না গিয়ে একটা প্লাকার্ড নিয়ে সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনে একা দাঁড়িয়ে গেল। এ বিশ্বকে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য করাই তার অঙ্গীকার। তার দাবি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বিশ্ব যে আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, তা মোকাবেলার জন্য তার দেশ সুইডেনকে এবং বিশ্বের সব দেশকে আরো জরুরি, আরো সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বালিকার নাম গ্রেটা থুনবার্গ। সে একনাগাড়ে দুই সপ্তাহ সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনে প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লিফলেট বিলি করে। লিফলেটে লেখা—‘আমি এসব করছি কারণ তোমরা, বড়রা আমাদের ভবিষ্যতের পথ আগলে আছ।

এ ঘটনার কিছুদিন আগেই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ ও দফায় দফায় দাবালনে সুইডেনবাসী জেরবার হয়েছে। গত ২৬২ বছরের মধ্যে সুইডেনে এত গরম পড়েনি। ইউরোপজুড়ে এ দাবদাহের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনই যে মূল কারণ, এতে খুব কম লোকেরই সন্দেহ ছিল। তাই এ বালিকার কর্মকাণ্ড সুইডেনবাসীকে নাড়া দেয়। দ্রুত এই একলা চলা বালিকার পাশে এসে অন্যরাও দাঁড়াতে শুরু করে।

বালিকাটি নিজে যেমন স্কুল বাদ দিয়ে পথে নেমেছিল, তেমনি সে অন্যদেরও আহ্বান জানায় জলবায়ুর দাবির সমর্থনে প্রতি শুক্রবার স্কুল ধর্মঘটের। ইউরোপ-আমেরিকার নানা শহরজুড়ে তরুণরা স্কুল-কলেজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। প্রতি শুক্রবার জলবায়ু ধর্মঘট। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থুনবার্গের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। সারা বিশ্বের পরিবেশবাদীরা তার পাশে দাঁড়ায়। চুল বেণি করা এক পঞ্চদশী জলবায়ু আন্দোলনের মুখপাত্রে পরিণত হয়। কারো কারো চোখে সে হয়ে ওঠে একজোয়ান অব আর্ক

গ্রেটা থুনবার্গের বয়স যখন ১১ বছর তখন সে মস্তিষ্কের এমন কিছু রোগে আক্রান্ত হয়, যা শিশুদের আচরণগত বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে। এ রোগ তাকে করে তুলেছে স্পষ্টভাষী আবার আবেগপ্রবণ। তার কথা শাণিত, সোজাসাপ্টা। ফাঁকা বুলি, মিথ্যা আশ্বাস ও বাগাড়ম্বরের এ যুগে এই বালিকার চাঁচাছোলা কথা অনেকের জন্যই, বিশেষত দক্ষিণপন্থী জলবায়ু সংশয়ীদের জন্য বিব্রতকর। বিব্রতকর এজন্য যে একটি বালিকা সব সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করছে, সোজাসাপ্টা ভাষায় তার জবাব দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

২. গ্রেটা থুনবার্গকে বিকল্প নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত সুইডেনেররাইট লাইভলিহুড পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য অন্যদের সঙ্গে তার নামও মনোনীত হয়েছে। তবুও এ মুহূর্তে জলবায়ু আন্দোলনের নায়ক গ্রেটা থুনবার্গ কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে জলবায়ু আন্দোলনবিরোধী প্রধান খলনায়ক যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, সে বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবে না। তিনি অর্থনৈতিক উন্নতি বিঘ্নিত হওয়ার ধুয়া তুলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের বৈশ্বিক প্রয়াসের বিরোধীদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নানা ওজর আপত্তি ও শর্ত আরোপ সত্ত্বেও ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ একমত হয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। তখন বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এ চুক্তির মূল লক্ষ্য বিশ্বের তাপমাত্রা শিল্প যুগের আগে যা ছিল, তার চেয়ে গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে কোনোমতেই না বাড়ে তা নিশ্চিত করা। আর এজন্য প্রতিটি দেশকে ক্রমান্বয়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে হবে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র এ প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই বছর ৮ নভেম্বর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার চারদিন পর এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর হয়।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধারণা ছিল উদ্ভট ও নেতিবাচক। তিনি কখনো বলেছিলেন যে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ধারণা চীনারা তাদের স্বার্থে তৈরি করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাকে অপ্রতিযোগিতাপূর্ণ করাই এর উদ্দেশ্য! কখনো বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা একটাধাপ্পাবাজি। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তি থেকে বের করে আনবেন।


ট্রাম্প একা নন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মানতে চান না এবং জলবায়ু চুক্তির বিরোধিতা করেন এমন লোকের অভাব নেই। এরা বর্তমানের লাভ-লোকসানের কারবারি। ভবিষ্যতে কি না-কি ঘটবে, তার চেয়ে এ মুহূর্তের প্রাপ্তিযোগ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর এদের পেছনে বিপুল অর্থ ও সমর্থন নিয়ে আছে বিশাল বিশাল তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো। কারণ বিশ্বের তাপমাত্রা হ্রাসের জন্য প্রধান যে কাজটি করতে হবে তা হলো, কয়লা-তেল-গ্যাস অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো আরো সক্রিয় ও উৎসাহী হয়ে ওঠে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য, সিনেটরসহ বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী গ্রুপ প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার জন্য ট্রাম্পের কাছে ধরনা দিতে থাকে।একে তো নাচনেওয়ালি বুড়ি, তার উপর পেল মৃদঙ্গের তাল। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের জুনে সগর্বে ঘোষণা দিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিতে আর থাকবে না। তার পর থেকে ট্রাম্প একের পর এক জলবায়ু চুক্তির পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন। যদিও চুক্তি অনুযায়ী প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া কার্যকর হবে ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর। অর্থাৎ আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরদিন।

৩. গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন গ্রেটা থুনবার্গ এক আবেগপ্রবণ বক্তৃতা দিয়েছে। এ বক্তৃতায় সে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেছে, ‘তোমরা ফাঁকা বুলি দিয়ে আমার স্বপ্ন, আমার শৈশব কেড়ে নিয়েছ। মানুষ মারা যাচ্ছে। সারা বিশ্বের ইকোসিস্টেম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তোমরা অর্থের আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রূপকথা শোনাচ্ছ! এত সাহস তোমরা পাও কোথায়?’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন