ভু ট্টা চা ষ

যমুনার চরে বাড়ছে আবাদ, বাড়ছে সম্ভাবনা

এইচ আলিম, বগুড়া

ভুট্টা চাষ বলতে একসময় যমুনা নদীকেন্দ্রিক এলাকায় চাষাবাদের কথা মনে উঠত। কিন্তু সময় এখন বদলেছে। বদলেছে চাষাবাদের ধরন। গতানুগতিক ফসল চাষে, বিশেষ করে ধান চাষে খরচ বেড়েছে কৃষকের। বিপরীতে লাভ কমেছে। তাই কৃষকরা এখন কম খরচে বেশি উৎপাদন হয়, এমন শস্যের দিকেই ঝুঁকছেন। এমনই একটি শস্য ভুট্টা। বগুড়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া, যমুনা, বাঙ্গালী ও ইছামতি নদী অঞ্চলে এখন এর চাষাবাদ দৃশ্যমান। অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভুট্টা। যমুনার তীরঘেঁষে চলা এ জেলাটিতে ভুট্টার আবাদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টা চাষে সম্ভাবনাও দেখছেন এখানকার কৃষকরা।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে দিন যত গড়িয়েছে, ভুট্টার আবাদ ততই বেড়েছে। শুরুর দিকে যমুনা নদীকেন্দ্রিক এলাকায় বেশি ভুট্টার চাষ হতো। তবে অন্য কিছু উপজেলায়ও ভুট্টার চাষ হতো। কিন্তু এখন জেলার ১২টি উপজেলায়ই কম-বেশি ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এছাড়া করতোয়া নদীবেষ্টিত শেরপুর ও যমুনা নদীর পাড় নিয়ে গড়ে ওঠা ধুনট উপজেলায় ভুট্টার চাষ বাড়ছে। এছাড়া যমুনা নদীর বুকে গড়ে ওঠা সারিয়াকান্দি ও বাঙ্গালী নদীর এক অংশে থাকা সোনাতলা ও গাবতলী উপজেলায় ভুট্টার আবাদ ক্রমে বাড়ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে জেলায় ভুট্টার আবাদ ২৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে জেলায় ভুট্টার আবাদ হতো মাত্র ২ হাজার ১৬৪ হেক্টর জমিতে। আর ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১০০ হেক্টর। আবাদের সঙ্গে সঙ্গে ফলনও বাড়ছে। আগে প্রতি হেক্টর জমিতে ভুট্টার ফলন হতো ৪ দশমিক ৭০ টন। যেখানে একই পরিমাণ জমিতে ২০১৮ সালে ফলন হয়েছে প্রায় ৮ দশমিক ৭৫ টন করে। ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলায় ভুট্টার উৎপাদনও বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে বগুড়ায় যেখানে ১০ হাজার ১৮৭ টন ভুট্টা উৎপাদন হতো, ১০ বছরের ব্যবধানে তা ৫১৪ শতাংশ বেড়ে ৭০ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।

উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রথমবারের মতো এ অঞ্চল থেকে বিদেশে ভুট্টা রফতানি হয়েছে। গত আগস্টে বগুড়া থেকে ১ হাজার ২০ টন ভুট্টা প্রতিবেশী দেশ নেপালে রফতানি করা হয়েছে। যার মূল্য ২ লাখ ৪২ হাজার মার্কিন ডলার।

বগুড়ার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে এখন দেশটির দুটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে ভুট্টা রফতানি করছে। তারা বলছে, পর্যায়ক্রমে ভুট্টা রফতানি আরো বাড়ানো হবে।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ধানের চেয়ে ভুট্টা চাষে বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধানের আবাদে কৃষক খুব একটা লাভ করতে পারছেন না। অন্যদিকে ধান চাষে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ পানিতেই ভুট্টা আবাদ হয়ে থাকে। ফলে ভুট্টা চাষে খরচ কমছে। এর বিপরীতে ফলন বেশি হওয়ায় অধিক লাভ পেতে ভুট্টা আবাদে ঝুঁকছেন কৃষকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোলট্রি শিল্পের ব্যাপক প্রসারের কারণে দেশে ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। বর্তমানে প্রতি বিঘায় ৩৫-৪০ মণ ভুট্টা পাচ্ছেন বগুড়ার কৃষকরা। ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মণ দরে এ ভুট্টা বিক্রি হয়ে থাকে। ভুট্টা চাষের পর থেকে বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত সর্বোচ্চ খরচ হয় ৭-৮ হাজার টাকা। আর এক বিঘা থেকে ভুট্টা বিক্রি করে ১০ হাজার টাকারও বেশি আয় করতে পারেন চাষীরা। পাশাপাশি ভুট্টার গাছ জ্বালানি, গো-খাদ্যসহ বিভিন্ন কাজে যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি সাথি ফসল হিসেবেও আবাদ করা যায়। ফলে ভুট্টা চাষে  বেশির ভাগ চাষী উৎসাহিত হচ্ছেন।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নেপালের পোলট্রি শিল্প পুরোটাই আমদানিনির্ভর। ভারতের বাজারে দাম বেশি হওয়ায় দেশটির পোলট্রি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে ভুট্টা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে ভুট্টা রফতানি হওয়ায় স্থানীয় চাষীরা ভুট্টা চাষে বেশ আশাবাদী। ধানের লোকসান দেয়া কৃষকরা ভুট্টা আবাদ করে তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে মনে করছেন তারা।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. মাসুদুর রহমান মিলন জানান, ২০১৮ সালে বগুড়া চেম্বারের মাধ্যমে মোট ৩ কোটি ৩০ লাখ ৪ হাজার ২৬০ মার্কিন ডলারের পণ্যসামগ্রী রফতানি করা হয়। চলতি বছরের শুরু থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে রফতানি হয়েছে ৪ কোটি ৮ লাখ ৩৭ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য।

তিনি বলেন, আগে ভুট্টার উৎপাদন কম ছিল। যে কারণে আমাদের দেশে চাহিদার সিংহভাগ ভুট্টাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। কিন্তু এখন পরিমাণে অল্প হলেও ভুট্টা রফতানি শুরু হয়েছে। বগুড়াসহ রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে যে পরিমাণ ভুট্টা উৎপাদন হয়, তার একটা বড় অংশ রফতানি করা সম্ভব, যা কৃষক তথা অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক।

বগুড়া থেকে যে দুটি প্রতিষ্ঠান নেপালে ভুট্টা রফতানি করছে, তাদের একটি মেসার্স কিবরিয়া ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বাহার জানান, নেপালে চাহিদার কথা জানার পর গত জুলাইয়ে বগুড়া থেকে এবং পরে দিনাজপুর অঞ্চল থেকে ভুট্টা কিনে রফতানি শুরু করি। প্রতি টন ভুট্টা ২৫০ ডলারে রফতানি করা হয়েছে।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, জেলায় ২০১৮-১৯ এ রবি ও খরিফ মৌসুম মিলিয়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে ৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। আগামী বছর চাষাবাদ আরো বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন