পেঁয়াজের দাম রেকর্ড বৃদ্ধি

স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের ওপর জোর দিন

ভারতে উৎপাদন কম হওয়ায় দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। বাংলাদেশেও এর প্রভাবে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। কিন্তু দেশীয় পেঁয়াজের দাম কেন ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে, তার কোনো ব্যাখ্যা মিলছে না কারো কাছ থেকে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, ভারতীয় পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ফায়দা লুটছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। দেশীয় পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ছে, তার কারণ খতিয়ে দেখার কোনো প্রয়োজনই কেউ অনুভব করছেন না। ভারতীয় পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ডামাডোলে স্থানীয় পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। বন্যার কারণে ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সতর্কবার্তা অনেক আগে থেকেই পাওয়া গিয়েছিল বিভিন্ন মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ও ব্যবসায়ীরা তাতে কর্ণপাত করেননি। ব্যবসায়ীরা না-হয় অতি মুনাফা লাভের প্রবণতায় ভিন্ন উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেননি। সরকার কেন ভোক্তাস্বার্থ নিশ্চিতে উদ্যোগ নিতে দেরি করল, তার কোনো সদুত্তর মেলেনি।

ব্যবসায়ীদের আমরা দুর্জন বলতে চাই না। আর সব ব্যবসায়ীর দায়দায়িত্ব ও নীতিনৈতিকতা একই পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না। তবে একশ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর লাভ ও লোভের কারণেই যে পেঁয়াজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। মুনাফালোভী এ মানসিকতা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সরকারের হাতে খুব একটা নেই। তার পরও টিসিবিকে কার্যকর করে একটি প্যারালাল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রেখে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা যায়। সরকার বলছে, পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। এর পরও পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বী হলো কী করে? এক্ষেত্রে কি কারো কোনো দায়দায়িত্ব নেই? সারা ঢাকায় পাঁচ-দশ জায়গায় কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করলে তার সুফল আসবে কীভাবে? অন্যান্য জেলা তো বাকি থাকছেই।

মৌসুমে কৃষকরা পেঁয়াজের দাম পান না। অথচ এখন দাম আকাশচুম্বী। এই বর্ধিত টাকাও উৎপাদক কৃষকরা পান না। পেঁয়াজ পচনশীল। পেঁয়াজ সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ প্রয়োজন। এজন্য পেঁয়াজ সংরক্ষণের দিকে মনোযোগী হতে হবে, যাতে সারা বছরই পেঁয়াজের সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায়। এছাড়া আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। মজুদ ব্যবস্থা জোরদার করাসহ স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে। তারও আগে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে পেঁয়াজ সিন্ডিকেট। লক্ষ করা যায়, কোনো পণ্যের দাম বিদেশের বাজারে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যবসায়ীরা নিজেরাই বাড়িয়ে দেন। এভাবে ক্রেতা ঠকানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে এবং দায়ীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিদেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দেশের বাজারে কেউ অতিরিক্ত মুনাফা লাভের চেষ্টা করছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। এ বিষয়ে কারো অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।

পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে হতদরিদ্র মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। কাজেই নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিরতা দূর করার জন্য সময়মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতা কমানো গেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থাকলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে বাজার অস্থির হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। সরকার দাবি করছে দেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ অথচ পেঁয়াজের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় ভারতের পেঁয়াজের ওপর নির্ভর করে। পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ কিন্তু বাংলাদেশের রয়েছে। কেন সে উদ্যোগ এত বছরে নেয়া হলো না বা পরিকল্পনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলো না, তার জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বিভিন্ন দেশে পেঁয়াজের বাজারদর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে সবচেয়ে কম দাম চীনা পেঁয়াজের। দেশটিতে উৎপাদিত পেঁয়াজের খুচরা বাজারে দাম প্রতি কেজি ২৭ থেকে ৪৩ টাকা, তুরস্কের পেঁয়াজের দাম ২৯ থেকে ৪০ টাকা, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৩৩ থেকে ৪৮ টাকা এবং ভারতের পেঁয়াজের দাম ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। চীনের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম ২৬ থেকে ৪২ টাকা ৫০ পয়সা, তুরস্কে ২৬ থেকে ৩৮ দশমিক ২৫ টাকা, মিয়ানমারে ২৬ থেকে ৪১ টাকা এবং ভারতের পাইকারি বাজারদর ৩৪ থেকে ৪৩ টাকা। দাম কম হলেও পচনশীল হওয়ায় বাংলাদেশের আমদানিকারকরা ভারত ছাড়া দূরের দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে আগ্রহী হন না। এর কারণ হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ জাহাজপথে অনেক ক্ষেত্রে পেঁয়াজ পচে যায়, এলসি (ঋণপত্র) খোলার পর দেশে পেঁয়াজ পৌঁছার আগেই এর দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা দূরের দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে আগ্রহী হন না।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নানা কারণের মধ্যে অন্যতম হলো দুর্বল বাজার মনিটরিং, অসাধু আমদানিকারক, উৎপাদক, পরিবেশক, সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী, অকার্যকর টিসিবি, সর্বোপরি ট্যারিফ কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে আদৌ কোনো সমন্বয় না থাকা। যে কারণে ভোক্তা ও ক্রেতাস্বার্থ অধিকার এবং সংরক্ষণ বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সিন্ডিকেট তথা মুুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী চক্রের বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও মুনাফা লুটে নেয়ার কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার, মেট্রো চেম্বারসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো খুবই শক্তিশালী। ফলে ভোক্তা ও ক্রেতাস্বার্থ এক রকম উপেক্ষিত এবং অনালোচিত থাকছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভ-ক্ষতি-মুনাফা ইত্যাদি থাকবেই। তবে এসব হতে হবে নীতি-নৈতিকতা, সততা ও নিয়মকানুনের আওতায়, যেখানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে বহুলাংশে। তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হওয়া।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন