ছোট ঋণে আগ্রহী ব্যাংক

চলতি মূলধনের অভাবে দুর্বল হচ্ছে বড় করপোরেটরা

হাছান আদনান

দুই বছর ধরেই তারল্য সংকটে ভুগছে দেশের ব্যাংকিং খাত। গত এক বছরে এ সংকট তীব্র হয়েছে। অনেক ব্যাংকের কাছেই বিনিয়োগ করার মতো টাকা নেই। এ অবস্থায় বড় ঋণ দেয়ার চেয়ে এসএমই ও রিটেইল খাতে বিনিয়োগকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলো বড় ঋণ দেয়ার চেয়ে আদায়ে বেশি মনোযোগী হওয়ায় চলতি মূলধন সংকটে পড়তে হচ্ছে দেশের সিংহভাগ বড় করপোরেটকে। চলতি মূলধনের অভাবে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ শিল্প গ্রুপ চলতি মূলধনের নামে এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করেছে। ঋণের এ অর্থেই জমি ক্রয়, কারখানা স্থাপন থেকে শুরু করে অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগও করেছে অনেক শিল্প গ্রুপ। এভাবে কোনো কোনো শিল্প গ্রুপ ৩০-৪০টি ব্যাংক থেকে একই ঋণ নিয়েছে। ব্যাংক আর আগের মতো টাকা না দেয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এ গ্রুপগুলোকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানও বলছে, আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিল্পে মেয়াদি ঋণ ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ কমেছে। যদিও একই সময়ে শিল্পে মেয়াদি ঋণ আদায় বেড়েছে ১৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ শেষে শিল্পে মেয়াদি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।

শিল্পে মেয়াদি ঋণের পরিমাণ কমলেও একই সময়ে এসএমই ঋণ বিতরণ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। ২০১৮ সালের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এসএমই ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১০ শতাংশ। মার্চ শেষে এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে কৃষি ও অকৃষি গ্রামীণ খাতেও। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষি খাতে ঋণ বেড়েছে ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ। অকৃষি গ্রামীণ খাতে এ প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম প্রান্তিকে বৃহৎ শিল্পে মেয়াদি ঋণ ও চলতি মূলধনের পরিমাণ আরো কমেছে। তারল্য সংকট ও অন্যান্য পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংকগুলো এখন বড় করপোরেটগুলোকে ঋণ দিতে চাইছে না। এরই মধ্যে যেসব গ্রাহককে বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে, তাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো টাকা আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে।

ব্যাংক নিজে বাঁচার স্বার্থেই ঋণ বিতরণে সতর্ক হয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করপোরেট খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্ট, বিদ্যুত্সহ বেশ কয়েকটি খাতে সমস্যা বেশি হচ্ছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা অনেক ব্যাংকের জন্য বিপদ ডেকে এনেছেন। বড় বড় অনেক করপোরেট মরে যাচ্ছে। এসব কারণেই ঋণ বিতরণে সতর্ক হয়েছে ব্যাংকগুলো।

বিষয়টি নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় অন্তত ১০টি করপোরেট গ্রুপের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তাদের প্রত্যেকেই জানান, ব্যাংকগুলোয় ঋণ চেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্প বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণের অনুমোদন প্রায় শূন্যে নেমেছে। চলতি মূলধন জোগানেও অনাগ্রহ দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এলসি খুলতেও চাইছে না। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। বড় করপোরেট বসে গেলে খেলাপি ঋণ বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে বেকারত্ব।

একটি শিল্প গ্রুপের চেয়ারম্যান তার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, সম্প্রতি একটি ব্যাংকের কাছে চলতি মূলধন হিসেবে ৫০ কোটি টাকা চেয়েছিলাম। বিপরীতে ব্যাংক ৫ কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। নগদ টাকার অভাবে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

শিল্প গ্রুপটির কর্ণধার চলতি মূলধন না পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও নাম প্রকাশ করতে চাননি। যদিও ঋণ পেতে ভালো শিল্প গ্রুপের কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, কিছু বড় করপোরেট সামর্থ্যের চেয়ে অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করেছে। এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করেছে। এমন অনেক শিল্প গ্রুপও আছে, যারা ৩০-৪০টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। বাস্তবতার নিরিখেই এসব গ্রুপকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সতর্কতা অবলম্বন করছে।

ঝুঁকি এড়াতেই ব্যাংকগুলো ছোট ঋণে আগ্রহী হয়েছে জানিয়ে এ ব্যাংকার বলেন, বড় ঋণ যেকোনো ব্যাংকের জন্যই বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নিজেদের ব্যালান্সশিটে বৈচিত্র্য আনতে চাইছে। এজন্য এসএমই, রিটেইলসহ ছোট ঋণে জোর দিচ্ছে। তবে স্থিতিশীল ও মানসম্মত শিল্প গ্রুপ চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে। ব্যাংক কোনো করপোরেটের এলসি খুলছে না, এমন অভিযোগ নেই।

দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ না পেয়ে বেশির ভাগ বড় করপোরেট ঋণের জন্য এখন বিদেশমুখী। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে দেশের শিল্প গ্রুপগুলো। ইস্পাত, বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, গার্মেন্টসহ ভারী শিল্প খাতের বেশির ভাগ বড় করপোরেট বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধির চেয়ে অফশোর ইউনিটের ঋণ প্রবৃদ্ধিও বেশি।

দেশে ব্যাংকঋণের উচ্চসুদহারও বিদেশী ঋণ নিতে করপোরেটদের উত্সাহিত করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বর্তমানে বস্ত্র ও পোশাক খাতে দেশে কোনো নতুন উদ্যোগ নেই। কোনো উদ্যোক্তাই নতুন শিল্প উদ্যোগের আবেদন করছেন না। এটিও আমাদের শিল্পের জন্য বড় সংকট। ১২-১৪ শতাংশ সুদ দিয়ে কোনো উদ্যোক্তার পক্ষেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।

এ ব্যবসায়ী বলেন, শিল্পের চরিত্রই হচ্ছে প্রবৃদ্ধি। এক জায়গায় স্থির থেকে কোনো উদ্যোক্তার পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। টিকে থাকতে হলে বড় হতেই হবে। এখন ব্যাংকগুলো যদি কোনো উদ্যোক্তাকে নতুন ঋণ না দেয়, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে। বিদ্যমান শিল্প চালিয়ে নেয়ার জন্য চলতি মূলধন না পেলে সে প্রতিষ্ঠান খেলাপি হতে বাধ্য।

দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতির এক-চতুর্থাংশই বৃহৎ শিল্পের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বৃহৎ শিল্প খাতের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংকঋণ স্থিতির ২৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। বৃহৎ শিল্পে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি। এর মধ্যে শুধু বৃহৎ করপোরেটগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার কোটি টাকা। ১১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ তৈরি পোশাক শিল্পে। এর বাইরে ট্রেড অ্যান্ড কমার্সে খেলাপি হয়েছে ২৬ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার ঋণ। এসব খেলাপি ঋণের বড় অংশই অল্প কিছু শিল্প গ্রুপের। আবার চেষ্টা-তদবির করেও দেশের বড় গ্রুপগুলোর কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। এজন্য ব্যাংকগুলোও বড় ঋণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

বড় করপোরেটগুলো ব্যাংকঋণ না পাওয়ার সত্যতা রয়েছে বলে জানান পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী। তিনি বলেন, বড় করপোরেটগুলো স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে। ফলে তারা চাইলেও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আবার ব্যাংক চাইলেও ওই করপোরেটকে চলতি মূলধন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বড় করপোরেটগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণকে এক-দুই বছরের জন্য সময় দিতে হচ্ছে।

এদিকে ব্যাংকের হাতে নগদ তারল্য বাড়াতে এডি রেশিওর সর্বোচ্চ সীমা কমানো হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর এডি রেশিওর সর্বোচ্চ সীমা ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৯ শতাংশ। নতুন সীমা বাস্তবায়নের জন্য চার দফায় সময়ও বাড়ানো হয়। কিন্তু সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের চারটি প্রজ্ঞাপনই বাতিল করে দিয়েছে। একই সঙ্গে এডি রেশিও ফিরে গেছে আগের সীমায়। এখন প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো আগের মতো আমানতের সর্বোচ্চ ৮৫ ও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে।

এডি রেশিও আগের সীমায় ফেরার কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান তারল্য সংকট কিছুটা হলেও কমবে বলে মনে করেন এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংকট নিরসনে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এডি রেশিও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ায় ব্যাংকগুলোর নগদ তারল্যের পরিমাণ বেড়েছে। উদ্যোক্তারা এ থেকে উপকৃত হবেন। তবে সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় উদ্যোক্তাদেরই মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। সংকটের সময় পরিচালন ব্যয় কমিয়ে প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হয়। এটিই ব্যবসার বিউটি।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন