শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী

নেতাদের উপলব্ধি হলে ১৫ আগস্টের আঘাত আসত না

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক নেতারা যদি তত্কালীন পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারতেন, তাহলে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আঘাত আসত না বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ক্ষত-বিক্ষত একটা দেশ, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু একটা দেশ, সেই দেশটাকে গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন ও দুরূহ কাজ। এটা যে একদিনেই, একটা কথায় গড়ে ওঠে না, এ উপলব্ধিটা যদি সবার মাঝে থাকত, তাহলে হয়তো ১৫ আগস্টের মতো এত বড় একটা আঘাত এ দেশের ওপর আসত না।

গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের বিশাল কর্মযজ্ঞ, অন্যদিকে দীর্ঘদিন বিদেশীদের রাজত্বে থাকা একটি ভূখণ্ডকে একটা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কঠিন কাজটি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময় নানা চক্রান্ত চলেছে। পাটের গুদামে আগুন দেয়া হয়েছে। থানা লুট করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাতজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। যারা স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকার-আলবদর ছিল, তারা অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আবার অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। আন্ডারগ্রাউন্ডের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তারা একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করেছিল।

তিনি বলেন, আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতা তখনকার অবস্থাটা বুঝতেই পারেননি। একটা দেশ দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিল, শোষিত ছিল, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা হয়েছে। তারা (পাকিস্তানি) এত সহজে ছাড়বে না। তাদের দোসররা ছিল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অব্যাহত থাকবে—এ উপলব্ধিটা তখনকার দিনে আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতার মধ্যেও আসেনি। তাই তারা এটা হয়নি, ওটা হয়নি নানা ধরনের প্রশ্ন ও কথা লেখালেখি অনেক কিছু শুরু করেছিল। উপলব্ধি হতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল তাদের। কেন তারা উপলব্ধি করতে পারেননি, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক জ্ঞানী-গুণী অনেকেই আছেন।

স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে পত্র-পত্রিকার লেখালেখির প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাহাত্তর সালের পর থেকে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত অনেক লেখালেখি আছে। আপনারা কেউ যদি এসব লেখায় একবার চোখ বুলান, পড়েন তখন দেখবেন কত ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল কথা তারা বলে গিয়েছিলেন। আর সেই খেসারতটা জাতিকে দিতে হলো পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, যারা এদেশের স্বাধীনতা চায়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, সেই আলবদর-রাজাকার-আলশামস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল-দোসরদের হাতে চলে গেল ক্ষমতা। তাদের হাতে যে ক্ষমতা চলে গেছে, সেটাও বোধহয় অনেকে উপলব্ধি করতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেন, এ ঘটনায় প্রথমে ভাবখানা এমন ছিল যে, এটা শুধু একটা পরিবারের ওপর আঘাত। কিন্তু এখানেই বোঝার ভুল ছিল, কারণ এটা একটা পরিবারের বিরুদ্ধে না। যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, তার প্রতিশোধ নেয়া এবং বিজয়কে ধূলিসাৎ করে স্বাধীনতাবিরোধীদের আবার পুনর্বাসিত করার জন্যই এই আঘাত—এ সত্যটা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা কখনো চায়নি বাঙালি জাতি মাথা তুলে দাঁড়াক। যারা কখনো বাঙালি জাতির অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে চায়নি, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকারটুকু কেড়ে নিতে চেয়েছিল, তাদেরই চক্রান্ত ছিল। কারণ বাঙালি জাতির বিজয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ বিজয় এরা কখনই মেনে নিতে পারেনি।

যুদ্ধপরবর্তী দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক বছর বাংলাদেশে এক ফোঁটা ফসল উৎপাদন হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকার কোনো পথ ছিল না। সব শিল্প-কারখানা বন্ধ ছিল।

একটা দেশ সম্পূর্ণভাবে অচল। হানাদার বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যখন ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা ফিরে এসে দায়িত্বভার নিলেন, তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, জাতির পিতার সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সাত ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছিল। চালের দাম ১০ টাকা থেকে ৩ টাকায় নেমে এসেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যখন ব্যাহত করা যাচ্ছিল না, তখনই ষড়যন্ত্র করে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে শেষ কথা বলেছেন, প্রয়োজনে বুকের রক্ত দেব। আর সেই রক্তই তিনি দিয়ে গেছেন। আমাদের সেই রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তার স্বপ্ন পূরণ হবে।

আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ এবং উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমীন। আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রমুখ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন