চা বিপণনে আধিপত্য কমছে পুরনোদের

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

একসময় দেশে চা বিপণনের দুই-তৃতীয়াংশই করত ইস্পাহানি গ্রুপ। তবে এ খাতে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান উঠে আসায় বাজার হিস্যা কমছে গ্রুপটির। সর্বশেষ অর্থবছরে ইস্পাহানি নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের ২৩ শতাংশ কিনে বিপণন করেছে। অথচ ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও গ্রুপটি নিলাম থেকে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ চা কিনেছিল।

ইস্পাহানির পাশাপাশি বহুজাতিক লিভার ব্রাদার্সের (বর্তমানে ইউনিলিভার) লিপটন তাজা, শ’ওয়ালেস ও ডানকান ব্রাদার্সও একসময় দেশে চা বিপণনে নেতৃস্থানে ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে চা বিপণনে নতুন নতুন ব্র্যান্ডের আবির্ভাবে আধিপত্য হারাচ্ছে এসব ব্র্যান্ডও।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের চা বিপণনের প্রবৃদ্ধি ৪-৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। প্রতিযোগিতামূলক এ বাজারে বিপণন পদ্ধতির কৌশল একসময়কার শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এর বিপরীতে বাড়ছে আবুল খায়ের, মেঘনা ও পারটেক্স গ্রুপের বাজার হিস্যা।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চা বিপণন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে চা নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি ব্রোকার্স। প্রতিষ্ঠানটির গত চার বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় চা খাতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য হারানোর চিত্র উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইস্পাহানি নিলাম থেকে চা কিনেছিল ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এর পর থেকে প্রতি বছরই প্রতিষ্ঠানটির বাজার দখল কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর ২৬, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২৪ ও সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২৩ শতাংশ চা ক্রয় কিনেছে ইস্পাহানি। অর্থাৎ চা ক্রয় ও বিক্রয়ের পরিমাণ কমলেও এখনো শীর্ষে রয়েছে গ্রুপটি।

ইস্পাহানি মির্জাপুর, জেরিনসহ একাধিক ব্র্যান্ড নামে চা বিপণন করে প্রতিষ্ঠানটি। নিজস্ব বাগান থাকলেও নিয়ম অনুযায়ী নিলাম থেকেই চা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি।

ইস্পাহানি চায়ের মহাব্যবস্থাপক ও বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ মঈনুদ্দিন হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে চায়ের বাজার দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বাজারে নতুন আসা প্রতিষ্ঠানগুলো জোরেশোরেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ইস্পাহানির বার্ষিক চা বিপণন প্রবৃদ্ধি এখনো অটুট আছে। পাশাপাশি ১০০ বছরব্যাপী এ দেশের সেরা ব্র্যান্ড হিসেবে চা বিপণনের ধারা অব্যাহত রেখেছে ইস্পাহানি।

দেশের একসময়ের আরেক শীর্ষ চা বিপণন প্রতিষ্ঠান বর্তমান ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। ইস্পাহানির পরই অবস্থান ছিল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির। নিজস্ব বাগান না থাকলেও নিলাম থেকে চা কেনার মাধ্যমে লিপটন তাজা প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের চা বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। ইউনিলিভার শুধু প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের চা বিপণন করায় বাজার দখলে পিছিয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি। ৮ শতাংশ বাজার দখল নিয়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশ রয়েছে চতুর্থ স্থানে। একইভাবে অবস্থান হারিয়েছে একসময় এ খাতের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান শ’ওয়ালেস ও ডানকান ব্রাদার্সও।

তবে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ২০০০ সালের পর চা বিপণনে আসা আবুল খায়ের গ্রুপ। ২০১৮-১৯ অর্থবছর নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের ২০ শতাংশ কিনেছে গ্রুপটি। যদিও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আবুল খায়ের গ্রুপ নিলামবাজার থেকে চা কিনেছিল ১৮ দশমিক ৭, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ১৮ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২১ শতাংশ। বিপণন কৌশল ছাড়াও চায়ের আনুষঙ্গিক একাধিক পণ্য উৎপাদনের কারণে আবুল খায়ের গ্রুপের সিলন ব্র্যান্ডের এ প্রবৃদ্ধি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দ্বিতীয় সারির প্রতিষ্ঠানগুলোর চা কেনার পরিমাণও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ ২০১৫-১৬ অর্থবছর নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ কিনলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছর কিনেছে প্রায় ১০ শতাংশ। চা ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চায়ের অবস্থান তৃতীয়।

এছাড়া ২০১৫-১৬ মৌসুমে পারটেক্স গ্রুপ (ড্যানিশ ও সিমলা চা) নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের ২ দশমিক ৯ শতাংশ কিনেছিল। ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে সর্বশেষ অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটির চা কেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ শীর্ষ চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে পারটেক্স গ্রুপ।

চা ক্রয় ও বিপণনকারীর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এইচআরসি ষষ্ঠ, এসিআই গ্রুপের টেটলি চা সপ্তম, ওরিয়ন অষ্টম, কনসোল নবম ও এম আহমেদ দশম অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েক বছরে নতুন উঠে আসা চা বিপণনকারীদের মধ্যে আছে কনসোল গ্রুপ, শবনম ইন্ডাস্ট্রিজ, মারিয়া টি কোম্পানি, মিন্টু টি কোম্পানি, আসিফ ব্রাদার্স, কামনা টি কোম্পানি, বনানী টি কোম্পানি ও কাজী টি। একসময় শীর্ষ ২০-এ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল আলী টি, শাওন চা কোম্পানি, রোজ টি, শ’ওয়ালেস বাংলাদেশ, নিউ বাংলাদেশ টি, ইমাম টি, মোল্লা টি ও বাংলাদেশ টি করপোরেশন।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শীর্ষ একাধিক করপোরেট গ্রুপ চা খাতে ব্র্যান্ডিং শুরু করেছে। এর মধ্যে অনেকেই বাগান কেনার মাধ্যমে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। সম্প্রতি সিটি গ্রুপ বেঙ্গল টি ও চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা গ্রুপ চা বিপণনে এসেছে। মোস্তফা গ্রুপের চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে উদালিয়া নামে একটি চা বাগান রয়েছে। এছাড়া সিটি গ্রুপের চা বাগান রয়েছে তিনটি। সিলেটের সাগুরনাল ও নাহার ছাড়াও চট্টগ্রামের চানপুর বেলগাঁও নামে চা বাগানে বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তবে চট্টগ্রামভিত্তিক সানোয়ারা গ্রুপ, টি কে গ্রুপসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান চা বিপণনে এলেও উল্লেখযোগ্য সুবিধা করতে পারেনি।

জানতে চাইলে এম আহমেদের ম্যাগনোলিয়া চায়ের প্রকল্পপ্রধান মো. ইকবাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, গত দুই দশকে চা বিপণনে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। ফলে বিপণন কৌশলসহ বিভিন্ন কারণে পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আধিপত্য হারাচ্ছে। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আসায় পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়ছে। আগামীতে চা বিপণন খাতের শীর্ষ পর্যায়ে নতুন প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ন্যাশনাল ব্রোকার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ অর্থবছর নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৭ কোটি ৯২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৫৮ কেজি। এর মধ্যে ইস্পাহানি গ্রুপ কিনেছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ২৭ হাজার ৯৩০ কেজি চা। এছাড়া আবুল খায়ের গ্রুপ ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮ হাজার ৬০৪ ও মেঘনা গ্রুপ ৭১ লাখ ৮ হাজার ৬৫৬ কেজি চা কিনেছে। অর্থাৎ শীর্ষ তিন কোম্পানিই চায়ের বাজারের ৫০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন