একজন প্রিয়া সাহা এবং অনেক প্রশ্ন

ড. সাজ্জাদ জহির

নিত্যকার অভ্যাসবশত ইউটিউব ঘাঁটতে গিয়ে মূল ঘটনার কিছুক্ষণ পরই আমি প্রিয়া সাহার ট্রাম্প-সাক্ষাতের ভিডিও দেখতে ও শুনতে পাই। কিছু নিকটজনের কাছে জানালে আমার শ্রদ্ধাভাজন একজন ফেসবুকে দেয়া জনৈক সেজান মাহমুদকে উদ্ধৃত করে লিখলেন: ‘ট্রাম্প নিজেই তার দেশের তিনজন মাইনোরিটি কংগ্রেস উইমেনকে তাদের অরিজিনাল দেশে (পিতৃ বা মাতৃভূমি) ফেরত যেতে বলেছে, যা ভয়াবহ রেসিস্ট কমেন্ট। তার কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের লোপাট হয়ে যাবার কাহিনী বলা আর অরণ্যে রোদন করা একই কথা।’ সে উদ্ধৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়, যারা ‘প্রিয়া সাহার পিণ্ডি চটকাতে’ উন্মুখ, তারা সম্ভবত বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি দীর্ঘকাল চলে আসা অন্যায় আচরণের ইতিহাস ভুলে গেছেন। অতি উদ্ভাবনীদের তৈরি সংখ্যা বিশ্লেষণে না গিয়েও সবাই স্বীকার করবেন (সম্ভবত) ভুটান ব্যতিরেকে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিরূপাচরণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এবং তাদের মধ্যকার প্রতিবাদী মন যখন বিজাতীয় স্বার্থে পথভ্রষ্ট হয় অথবা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে ক্ষমতাধরদের করুণা পেতে সচেষ্ট হয়, তখন সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু উভয়ের মাঝে বিড়ম্বনা জাগে। অতি প্রতিক্রিয়ার ফলে সংখ্যাগুরুদের কারো কারো মাঝে আগ্রাসী মন বাড়তি ইন্ধন পায়। তারই প্রকাশ দেখতে পাই ফেসবুকে প্রচারিত অন্য একটি অভিব্যক্তিতে, যেখানে জয়া চ্যাটার্জির লেখা ‘বাঙলা ভাগ হল (হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ-বিভাগ ১৯৩২-১৯৪৭)’ বইটির বক্তব্য টেনে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দাবি করা হলো যে ‘১৯৭১ সালে বাংলা ভাগ হইছিলো হিন্দুদের কারণে।’ অতএব, তার পরিণতির জন্য ‘হিন্দু’রাই দায়ী! ঠিক যেমনটি প্রিয়ার ধারণকৃত ভিডিওর শেষাংশে সেই কথিত ভিটেমাটি ছাড়ার দোষ ‘মৌলবাদী মুসলমান’দের ওপর চাপিয়েছিল! একই ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমরা আগেও দেখেছি। ক্ষমতার বলয়ে সংখ্যালঘু নারীদের প্রতিবাদী মনের পথভ্রম হওয়ার দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। একইভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ধর্মকেন্দ্রিক উগ্রতার প্রকাশ আমরা বিপরীতমুখী উভয় শিবিরেই দীর্ঘকাল লক্ষ করে আসছি।

ভিন জাতের মানুষ এবং তাদের সম্পদ শাসন ও শোষণ সহজ করার জন্য ব্রিটিশদের বিভাজন নীতির প্রসঙ্গ প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু আমাদের দুর্বলতা ঢেকে বাইরের শক্তিকে দোষ দিয়ে কোনো জাতির পক্ষে সুস্থ ও স্বাধীনভাবে এগোনো সম্ভব নয়। একইভাবে যেসব অশুভ শক্তি এবং বহির্দেশের নীতিমালা আমাদের মাঝের বিভক্তি আনতে ইন্ধন জোগাচ্ছে, সেসবের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক বা প্রতিবাদী পদক্ষেপ নেয়া আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতিতে বৈষম্য হ্রাস করে বাইরের ইন্ধনের প্রভাব থেকে স্বদেশকে মুক্ত রাখা। এটা সত্য যে, নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবে রচিত ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় আমাদের সমাজে নানা ধরনের বিভাজন তৈরি হয়েছে। মনন ও বাস্তবের বিবিধ বাঁধন বা গিঁট খুলতে হলে অনেক অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। তাই সুষ্ঠু মতামত বিনিময়ের প্রয়োজনে ‘আমরা’ বা ‘আমাদের’ ভৌগোলিক ও জাতিগত অবস্থান স্থির করা আবশ্যিক। ঐতিহাসিক কারণেই আলোচনার শুরুটা দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী এবং একই ভূখণ্ডে বসবাসরত অন্যান্য নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে। বলতে দ্বিধা নেই যে, এ জনগোষ্ঠীর যেসব অংশ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে উপমহাদেশের বা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের শিকড়ের সমৃদ্ধি আনতে সচেষ্ট, তারাও ‘আমাদের’ মাঝে অন্তর্ভুক্ত। 

টাইমস অব ইসরায়েলের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত বৈঠক ভোজসভায় বহুল প্রচারিত ইসরায়েল ও বাহরাইন কূটনীতিকদ্বয়ের ছবির পেছনে প্রিয়া সাহার বসে থাকার ছবি প্রকাশ পাওয়ায় সামাজিক মাধ্যমে অনেক গুঞ্জন শোনা যায়। অনেকে ইসরায়েলের গন্ধ পেয়ে অতিমাত্রায় ইসলামী হয়ে পিরোজপুরের সারি নামের এনজিওর নির্বাহী পরিচালক প্রিয় বালা বিশ্বাসকে (প্রিয় সাহার বিবাহপূর্ব নাম) একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলোয়াড় হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। একই সঙ্গে এ-জাতীয় ঘটনায় রাষ্ট্রীয় পক্ষের নিষ্ক্রিয়তায় বিভিন্ন পক্ষের বিড়ম্বনার প্রকাশ পাওয়া যায়। যেমনভাবে আমাদের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা-পাতি নেতার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দেনদরবার আমাদের মাঝে বিড়ম্বনা আনে, একইভাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে প্রিয়া সাহার নালিশ বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশে বসবাসরত সব ধর্ম ও নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য গ্লানিময়। এ গ্লানি থেকে মুক্তির পথ নিয়ে লেখাটি ভবিষ্যতের জন্য রেখে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে এ নাটকের ‘শানে-নজুল’ বুঝতে সচেষ্ট হব।

ঘটনার সময়কাল বিচার করলে এটা অনুধাবনযোগ্য যে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে প্রিয়া সাহা ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ (রিলিজিয়াস ফ্রিডম) শীর্ষক একটি বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। একই সফরসূচিতে এটা অস্বাভাবিক নয় যে, অংশগ্রহণকারীদের জন্য অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। তার মধ্যে ‘মিট দ্য প্রেসিডেন্ট’ (মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার) অনুষ্ঠানটি খুবই স্বাভাবিক। অর্থাত্ যে দুটো ঘটনা গণমাধ্যমে অধিক প্রচার পেয়েছে, তা একই সূত্রে গাঁথা। এ ধরনের আমন্ত্রণ সচরাচর ঘটে এবং বিদগ্ধজনরা যেমন লাইভ টকশোতে আবেগবশত অথবা নিজেকে জাহির করার জন্য বক্তব্যে অতিরঞ্জন মেশায়, প্রিয়া সাহার ট্রাম্প-সংস্পর্শের আচরণ সেই সাদামাটা দৃষ্টিতে দেখলে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রয়োজন হয় না। ইসরায়েলের পত্রিকায় প্রকাশিত দ্বিতীয় ঘটনাটির ব্যাখ্যা ছবিটির সামগ্রিক ক্যানভাসে দুজন নারীর চুপচাপ বসে থাকাতেই সুস্পষ্ট হয়। নেট ঘাঁটলেই জানা যায়, এ বছরের ২৫ জানুয়ারি ‘রিলিজিয়াস ফ্রিডম ইনস্টিটিউট’-এর প্রেস বিজ্ঞাপনীতে ১৬-১৮ জুলাই দ্বিতীয় মিনিস্টারিয়াল হওয়ার ঘোষণা আসে। জুনে পুনরায় তা নিশ্চিত করা হয় এবং তিনদিনের কর্মসূচি দেখলে জানা যায়, অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিনের বিষয়বস্তু ছিল ‘সরকারি পদক্ষেপ’ (গভর্নমেন্ট অ্যাকশন), যার আওতায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে উল্লেখ রয়েছে ‘Survivors or close relatives of those who suffered persecution due to their religion or beliefs will share their stories.’ এটারই আওতায় সম্ভবত প্রিয়া-ট্রাম্প কথোপকথনের ভিডিও আমরা দেখেছি। এসব সারভাইভারদের একটি তালিকা বায়োগ্রাফিস অব সারভাইভারস সেকশনে রয়েছে এবং সেখানে প্রয়াত অভিজিত রায়ের বিধবা স্ত্রী বন্যা আহমেদ এবং নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে আসা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডা. ফরিদ আহমেদের নাম রয়েছে, প্রিয় সাহা বা প্রিয় বালা বিশ্বাসের নাম নেই।

ইন্টারনেট ঘাঁটলে আরো জানা যায়, এ অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের (বার্মা) ওপর একটি বিবৃতি রয়েছে, যেটিতে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের সরকারি প্রতিনিধি যৌথভাবে সই করেছেন (বেশকিছু মুসলমানপ্রধান দেশ ছাড়াও কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র অন্তর্ভুক্ত)। বিবৃতিতে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসা ৭ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার কথা এবং রাখাইন প্রদেশে ক্যাম্পে আবদ্ধ ১ লাখ ২৭ হাজার রোহিঙ্গার উল্লেখ রয়েছে। সংখ্যার কিছু হেরফের এনে ২৬ জুলাই আবারো বার্মার ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের ওপর কোনো বিবৃতি সেখানে আসেনি। 

উপরের বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রিয়া উপাখ্যানের একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা নিম্নরূপ: ক্ষমতাধর দেশগুলোয় অবস্থিত কিছু সংস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবিধ অনুষ্ঠান সংঘটিত করে এবং সেখানে প্রটোকলভিত্তিক অংশগ্রহণ ছাড়াও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মী ও তথাকথিত সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তেমনি আমন্ত্রিত একজন ব্যক্তি প্রিয়া সাহা, যিনি অর্বাচীনের মতো কাজ করেছেন। তার ক্ষোভে যৌক্তিকতা থাকতে পারে কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র বুঝে নিজেকে প্রকাশ করার বোধ-বিচার নেই।

উপরের গল্পের সামান্য হেরফের এনে অনেকে বলেন, আয়োজক ও দেশীয় সরকারের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য হয়তো ছিল না। কিন্তু তৃতীয় কোনো শক্তি (সে ব্যক্তি হোক বা গোষ্ঠী) তার ওপর প্রভাব খাটিয়ে তাকে দিয়ে এমন কাজটি করিয়েছে। পত্রপত্রিকায় বহির্দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী কিছু ব্যক্তির নাম উঠেছে। এ গল্পটাও ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ হয়ে অর্বাচীনতার শামিল। তবে শক্তি যদি দেশ বা ভিনদেশী সরকার বা ভিনদেশের কোনো গোষ্ঠী হয়, তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। এক্ষেত্রে দুটো সম্ভাব্য ‘গল্প’ রয়েছে। প্রিয়া সাহার উদ্ধৃতি ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থিত ধর্মান্ধরা এবং এনআরসিকে জাতিগত নিপীড়নে (ও নির্বাসন) ব্যবহার করতে উদগ্রীব অনেককেই মাঠে নামতে দেখা গেছে। অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিয়ে বার্মাবিরোধী বিবৃতি দেয়ার মঞ্চে বাংলাদেশকে হেয় করার মতো উত্তম হাতিয়ার আর কিছুই হয় না!

যদি শেষের দুটো গল্পের কোনোটি সত্য হয়ও, তা পূর্বপরিকল্পিত নাকি মাঝপথে পরিকল্পিত বা আকস্মিকভাবে প্রভাব ফেলানো নাকি ঘটনা-পরবর্তী সুযোগ নেয়া, তা আদতেই জানা যাবে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে। তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, এ-জাতীয় অনুষ্ঠানে কেন প্রিয় সাহার মতো একজন নারীকে নেয়া হলো। আগেই বলেছি, যেসব উপাত্ত দিয়ে তাকে একজন বিশ্বপর্যায়ের খেলোয়াড় ভাবা হচ্ছে, তা ধোপে টেকে না। তাহলে কেন তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো? বন্ধুমহলে এ প্রসঙ্গে আলোচনায় জানা গেল যে তার প্রতিষ্ঠিত ও চালিত ‘সারি’ এনজিও পিরোজপুর জেলায় কাজ করে এবং অনেকের মতে, পায়রাবন্দর ও তত্সংলগ্ন এলাকায় বিনিয়োগ বিস্তৃতির ফলে নিকট পশ্চিমে অবস্থিত বলেশ্বর নদের মোহনার কৌশলগত গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরায়েলি পত্রিকায় উদ্ধৃত ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স’-এর বিষয়টি এ কারণেই বিশেষ তাত্পর্য বহন করে!

গল্প যেদিকেই মোড় নিক না কেন, এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা কি রাষ্ট্রের শোভা পায়? বরং যখন এ ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটে, সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা অতীতের অনেক জঞ্জাল দূরে ঠেলে সমাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। আমাদের চারপাশে যা ঘটছে সেসবের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া সবার জন্য কাম্য। নানা যুক্তিতে অতিসাবধানী হয়ে রাষ্ট্রপক্ষের নীরবতা দেশ ও দশের জন্য মঙ্গল আনে কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত।

 

ড. সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন