মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু

মেহেদী হাসান

১৫ আগস্ট ১৯৭৫—এটুকু লিখে থেমে যেতে পারলে ভালো হতো। এই দিনের বর্ণনা দেয়ার মতো কষ্টদায়ক ঘটনা বাঙালির জীবনে আর নেই। সময়ের ব্যবধানে প্রতিটি মুহূর্ত স্মৃতিতে পরিণত হয়, যা কখনো আনন্দের, আবার কখনো কলঙ্কের। আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় কলঙ্কিত মুহূর্তের নাম ১৫  আগস্ট। আমরা হারিয়েছি বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সব মৃত্যুই নির্মম দুঃখ আর যন্ত্রণা দিয়ে যায়। আর কিছু মৃত্যু জাতি হিসেবে দায়বদ্ধ ও ঋণগ্রস্ত করে তোলে। কিছু সংকীর্ণ, বিপথগামী, মানসিক বিকারগ্রস্ত উন্মাদের নারকীয় ধ্বংসলীলার যন্ত্রণা আজো জাতি বয়ে বেড়াচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি আদর্শের নাম, একটি চেতনার নাম, একটি সংস্কৃতির নাম, সর্বোপরি স্বাধীনতার নাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর শারীরিক মৃত্যু হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর নামের মৃত্যু ঘটেনি, আদর্শের মৃত্যু ঘটেনি। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সফলতা আর ঘাতকদের চরম ব্যর্থতা। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধু আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। হাজার বছর চলে যাবে, তবুও বাঙালির হূদয়ে চির অমলিন হয়ে থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে বঞ্চিত, নিপীড়িত, উপেক্ষিত, বুভুক্ষু জাতির মুক্তির দূত হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; যার হাত ধরে হাজার বছরের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত বাঙালি অর্জন করেছিল আজন্ম কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। এ চির প্রত্যাশিত মুক্তির রচয়িতা ও নায়ক একত্র করেছিলেন পুরো জাতিকে। পরিচালিত করেছিলেন মহান মুক্তির সংগ্রাম, দিয়েছিলেন সেই স্বপ্নময় স্বাধীনতা। আর নিজে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রিয় বন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। যে নেতৃত্বের মাধুর্য ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী আর তিনি হয়ে উঠেছেন অতুলনীয়, বহুগুণে গুণান্বিত একজন বিশ্বনাগরিক। বঙ্গবন্ধুকে শুধু নেতা বা শাসক বললে তাঁকে সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। তিনি ছিলেন বিশ্বনেতা। তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা, ব্যক্তিত্বের সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতার আসনে বসিয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন বাঙালি জাতির হূদয়ে, যা কখনো হারানোর নয়। মননে ও মগজে তিনি ছিলেন প্রকৃত বাঙালি। পাকিস্তানে জেলখানায় তাঁর চোখের সামনে কবর খোঁড়া হয়েছিল, নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে নিঃশঙ্কচিত্তে বলেছিলেন, ‘আমি নতি স্বীকার করতে জানি না। আমি বাঙালি, আমার দেশ বাংলাদেশ।’ লন্ডন অবজারভারের বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইরিল ডান তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিব একমাত্র নেতা, যিনি রক্ত, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও জন্মগতভাবে ছিলেন সম্পূর্ণরূপে বাঙালি।’ জাতিসত্তার প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর গভীর গর্ব ও শ্রদ্ধাবোধ। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অনুভূতিকে পদদলিত করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ দেশের নামকরণ করেছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে ‘আমি আজ ঘোষণা করছি যে পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলে নামকরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে সফল সংগঠক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—জাতির এ ক্রান্তিকালে তাঁর বলিষ্ঠ সাংগঠনিক দক্ষতা আর সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনবিদিত একচ্ছত্র নায়ক। যেমনটা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা মওদুদ আহমদ তার ‘বাংলাদেশ, শেখ মুজিবুর রহমানের যুগে’ বইয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে শেখ মুজিবের আবির্ভাব সবচেয়ে বড় ঘটনা। তাঁকে কবর দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে আরো কার্যকর, দক্ষ, সক্ষম এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবির্ভূত হতে পারে বা হবে, কিন্তু এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছেন এবং জাতিকে নতুন পরিচয় দিয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মানুষকে ভালোবাসতে পারার মধ্যে, দেশের মানুষকে তিনি অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে বেঁধেছিলেন আত্মিকতার বন্ধনে। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় বিবিসির সাংবাদিক স্যার ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘আমার সর্বোচ্চ শক্তি আমার লোকদের জন্য ভালোবাসা, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ দুর্বলতা আমি তাদের অনেক বেশি ভালোবাসি।’ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি অবস্থায় চলা নির্যাতনময় পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা  করেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমার আদর্শ আর সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্যই আমি এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পেরেছি। এই জনগণ আমাকে তাদের ভাই, তাদের পিতা এবং তাদের নেতা হিসেবে ভালোবাসে।’ আপনার কাছে দেশ না পরিবার আগে? এ প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জীবনটা দেশ এবং জনগণের সেবায় উৎসর্গকৃত। এবং এরপর আমার পরিবারের প্রশ্ন ওঠে।’ তাঁর সম্বোধনে ছিল বিশ্বভ্রাতৃত্বের আহ্বান—‘আমার ভাই ও বোনেরা’, ‘আমি’ না বলে বলতেন ‘আমরা’। সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ কখনই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। এমনকি ক্ষমতার মসনদও তাঁর আগ্রহের বস্তু ছিল না। ৭ মার্চের ভাষণে অকপটে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ ছিলেন ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, সবসময় অন্য ধর্মের চর্চা ও স্বাধীনতার বাধাহীন সুযোগের ব্যাপারে ছিলেন রক্ষক। মার্চের ওই উত্তাল সময়ের মধ্যেও সে কথা ভোলেননি। তাই উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়’ [৭ মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশ সংবিধান পঞ্চম তফসিল ১৫০(২)অনুচ্ছেদ]। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আত্মবিশ্বাসী আর সঙ্কল্পে অবিচল। কোনো কিছুই টলাতে পারেনি তাঁর আত্মবিশ্বাসকে। ২৫ মার্চ কালরাতে একজন পুলিশ সদস্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন পুলিশের পোশাক পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আত্মগোপন করার জন্য। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘ও ধস  হড়ঃ ধ নধপশ ফড়ড়ৎ চড়ষরঃরপরধহ. আজ যদি আমি পালিয়ে যাই, তাহলে বাঙালি জাতি কোনো দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না’ (ফারুক আহমেদ বাচ্চু, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা)। তিনি ছিলেন সফল ভবিষ্যত্দ্রষ্টা। খুব ভালোভাবে বুঝেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম শুধু প্রকাশ্য শত্রুর সঙ্গে নয়, অপ্রকাশিত দেশী শত্রুর সঙ্গেও, ‘মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ধুঁকছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে (৭ মার্চের ভাষণ)। সেটাই হয়েছিল ২৫ মার্চের কালরাতে আর স্বাধীনতার পুরোটা সময়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের স্বীকৃতি সবসময় তাঁর অনুসারীদের আনুগত্য এবং নেতার প্রতি বিশ্বাসের মধ্যে প্রকাশ পায়। তাঁর একান্ত সহচর ও মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননের ভাষণে প্রিয় নেতার ব্যাপারে বলছিলেন, ‘আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই’ (হাবিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতার জেল হত্যা)। তাঁর ব্যক্তিত্ব আর বাচনভঙ্গির মধ্যে ছিল চুম্বকীয় আকর্ষণ শক্তি, এক অনবদ্য সত্য আবেদন। বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক স্যার মার্ক টুলি, যিনি বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তার ভাষায়, ‘শেখ সাহেবের বক্তব্য শুনতে আমি জনসাধারণের সঙ্গে বিভিন্ন সভায় যোগ দিয়েছিলাম। তাঁর কণ্ঠ ছিল চমত্কার, যা জনতাকে মুগ্ধ করে তুলতো। আমি জনগণের প্রতিক্রিয়া থেকে সেটা অনুভব করতে পারতাম।’

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সীমাহীন বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক। এ জাতিকে তাঁর সমান বিশ্বাস আর কেউ করেনি বলেই ধারণা করা যায়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ আরো বেশকিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু গভীর বিশ্বাসের কারণে তিনি কখনই এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেননি। এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিল। উত্তরে শেখ মুজিব বলছিলেন, ‘এরা আমার নিজের সন্তান, এরা আমার ক্ষতি করবে না।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব, আকাশসম ব্যক্তিত্ব, অসম্ভব সাহস এবং জাতির প্রতি সীমাহীন বিশ্বাস আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্য পেয়েছেন বিশ্বমর্যাদা। শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্বীকার করে নিয়েছেন বিশ্বের গুণীজনরা এবং স্থান দিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। প্রয়াত ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতা লর্ড ফেননার ব্রকওয়ে বলেছিলেন, ‘এক অর্থে জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী ও দে ভ্যালের চেয়ে শেখ মুজিব বড় মানের নেতা।’ মিসরের সাংবাদিক হাসানিন হিকাল দিয়েছিলেন বিশ্বনাগরিকের সম্মান, ‘শেখ মুজিবুর রহমান একমাত্র বাংলাদেশের নন। তিনি সকল বাঙালির জন্য মুক্তির দূত। তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির নতুন উদ্ভব। মুজিব বাঙালিদের সবসময়ের নায়ক।’ আমাদের শ্বাপদসংকুল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনবদ্য অভিযাত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের আবিষ্কারক। তাঁর সংগ্রামের মহাকাব্য পঠিত হয় পৃথিবীর শতসহস্র নিরীহ, নিপীড়িত, বঞ্চিত, মুক্তিকামী জনতার হূদয়ে, তাঁর আদর্শ অনুপ্রাণিত করে সব অন্যয়, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, তাঁর নেতৃত্বে আজো বিশ্ব খুঁজে পায় স্বাধীনতার সুখ। এটাই বঙ্গবন্ধু, এটাই তাঁর শৈলী, এটাই তাঁর আদর্শ। আপনি ছিলেন, আপনি আছেন, আপনি থাকবেন।

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান

ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’— অন্নদাশঙ্কর রায়।

 

মেহেদী হাসান: শিক্ষক

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন