কিউবায় পাট রফতানি করে বিপদে পড়েন বঙ্গবন্ধু

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাধীনতার পর পরই কিউবার সঙ্গে চমত্কার কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাংলাদেশের। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ফিদেল কাস্ত্রোর আন্তরিক সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে আরো গভীরতা পায় এ সম্পর্ক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে দেশটিতে পাটের থলে রফতানিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় বাংলাদেশ। কিন্তু কিউবার সঙ্গে এ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন বিপদে ফেলে দেয় বঙ্গবন্ধুকে। বাংলাদেশের জন্য প্রতিশ্রুত খাদ্য সহায়তাবাহী জাহাজ আটকে দেয় কিউবার শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র। একই বছরের জুলাই-আগস্টে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। বিপর্যস্ত হয় শস্য উৎপাদন। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিশ্রুত খাদ্য সহায়তা না আসায় চরম বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ। ইতিহাসের ভয়াবহতম এক দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করতে হয় বঙ্গবন্ধুকে।

স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এ ক্ষয়ক্ষতি শুধু ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধসে পড়েছিল পুরোপুরি। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের পক্ষেও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কোনো অর্থনৈতিক কর্মসূচির রূপরেখা দাঁড় করানো সম্ভবপর হয়নি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের গুরুভার নিজ কাঁধে তুলে নেন বঙ্গবন্ধু। দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে একের পর এক পর্বতসম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তিনি। তার পরও নিজ দেশপ্রেম ও কর্তব্যবোধ দিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে থাকেন বঙ্গবন্ধু।

দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর পথকে আরো কণ্টকাকীর্ণ করে রাখে যুক্তরাষ্ট্রের বিরূপ আচরণ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিক্সন প্রশাসনের অবস্থান ছিল বাংলাদেশের প্রতিকূলে। সেই একই ধারা বজায় থাকে স্বাধীনতার পরও। মার্কিন সরকারের এ বিরূপ মনোভাব চরমে ওঠে কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের পর। অন্যদিকে ১৯৭৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলে রিচার্ড নিক্সনের কাছ থেকে হোয়াইট হাউজের নিয়ন্ত্রণভার জেরাল্ড ফোর্ডের হাতে গেলেও এ অবস্থান বদলায়নি যুক্তরাষ্ট্রের।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য যেভাবে প্রয়োজন, শুরু থেকেই সে হারে বৈদেশিক সহায়তা পাচ্ছিল না বাংলাদেশ। প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া দূরের কথা, এমনকি বাংলাদেশীদের শ্রমের বিনিময়ে রেমিট্যান্স অর্জনের সুযোগ প্রায় ছিল না বললেই চলে। উপরন্তু বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রও ছিল একেবারেই সীমিত। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর অবস্থানও ছিল পুরোপুরি অসহযোগিতামূলক।

দাতা দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সহায়তাসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও সেগুলো বাস্তবায়নে বেশ গড়িমসি করছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের তত্কালীন উপচেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও ইউএসএইডের উপপ্রশাসক মরিস উইলিয়ামের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মার্কিন পিএল-৪৮০ টাইটেল ওয়ান প্রোগ্রামের অধীনে বাংলাদেশের জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে ২ লাখ ২০ হাজার টন গমের পাশাপাশি ২০ হাজার টন ভোজ্যতেল বরাদ্দের অনুরোধ করা হয়।

এরপর ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে বাংলাদেশের জন্য ২ দশমিক ২ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য ও ১ লাখ ২৮ হাজার টন সয়াবিনের জরুরি প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। বৈঠকে জানানো হয়, বিশ্ববাজারে খাদ্যের মূল্য বেশ চড়া হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায়ই বিশ্ববাজার থেকে নিজস্ব সম্পদের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এক মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি পর্যায়ে। এজন্য টাইটেল ওয়ানের অধীনে আরো কিছু গম বরাদ্দ এবং পূর্ববর্তী সহায়তা প্রতিশ্রুতি থেকে গম ও সয়াবিনের তাত্ক্ষণিক ক্রয় অনুমতির ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হয়।

এদিকে এমনই এক মুহূর্তে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালে কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ মূল্যে ৪০ লাখ পাটের থলে বিক্রির জন্য কিউবার সঙ্গে এক চুক্তি করে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)।

সমাজতান্ত্রিক কিউবার ওপর সে সময় বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সঙ্গে এ বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসের বিষয়টিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিযুক্ত তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সাক্ষাৎ করেন। এ চুক্তির বিষয়টিকে পিএল-৪৮০ খাদ্য সহায়তা প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন বলে দাবি করেন ডেভিড বোস্টার।

সে সময় অনেকটা আকস্মিকভাবেই বাংলাদেশের কাছ থেকে কিউবায় কোনো কৃষিপণ্য রফতানি করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির এ হঠাৎ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য ছিল পুরোপুরি বিস্ময়কর। কারণ কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা চলছিল বেশ কয়েক মাস আগে থেকে।

মার্কিন পিএল-৪৮০ খাদ্য সহায়তা কার্যক্রমের একটি শর্ত হলো, কোনো দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ আরোপ করলে সে দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনকারী দেশ এ কার্যক্রমের আওতায় সহায়তা পাবে না। তবে অকৌশলগত কৃষিপণ্য, অকৌশলগত কৃষি উপকরণ ও চিকিৎসা পণ্য সরবরাহের কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে ছাড় দেয়ার সুযোগ ছিল এতে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়, কিউবার সঙ্গে লেনদেনটি একটি বিচ্ছিন্ন লেনদেন এবং এটি কোনো চলমান বাণিজ্য চুক্তির অংশ নয়। এছাড়া বিজেএমসি মার্কিন কংগ্রেসের পিএল-৪৮০ অ্যাক্টের অধীন নিষেধাজ্ঞা বিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় বলেও জানানো হয়। অন্যদিকে কিউবাও আলোচনার সময় বিষয়টি বাংলাদেশের নজরে আনেনি।

এছাড়া বাংলাদেশের সামনে অনুকূল কিছু দৃষ্টান্তও ছিল। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ ক্ষমতাবলে সে সময় কিউবায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে গাড়ি রফতানির বিশেষ অনুমতি দেয়া হয়েছিল। বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাট ও পাটপণ্য রফতানিতে বিশেষ ছাড় বা অব্যাহতির অনুরোধও জানানো হয়। এছাড়া ওই সময় তুলা রফতানিকে কেন্দ্র করে মিসরকে ছাড় দেয়ার উদাহরণও ছিল বাংলাদেশের সামনে।

কিন্তু তার পরও অনড় অবস্থানে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশকে নতি স্বীকার করাতে খাদ্য ও ভোজ্যতেলের সহায়তা বাবদ প্রতিশ্রুত চালান আটকে দেয় দেশটি। অন্যদিকে জুলাই-আগস্টের ভয়াবহ বন্যার পর দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিলে বিষয়টি নিয়ে শংকিত হয়ে ওঠে প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত মার্কিনিদের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। কিউবায় পাট রফতানি বন্ধের পর দেশে আবারো খাদ্য সহায়তা পাঠাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ততদিনে বন্যা ও দুর্ভিক্ষ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন