বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কূটনৈতিক দর্শন

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালি শুধু একজন মানুষই নন, একটি চেতনা, একটি অধ্যায়। তিনি এ দেশের গণমানুষের মুক্তির উপলক্ষ, এ জনপদের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার রূপকার। তাঁর হাত ধরেই লাল-সবুজের একটি স্বাধীন পতাকার অধিকার পায় এ বঙ্গভূমি। পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের কূটকৌশল ছিন্ন করে তাঁর দূরদর্শী রাজনীতি ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের বলেই ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে অংকিত হয় আমাদের এই প্রাণের বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই তিনি এ দেশের মাটি ও মানুষকে পুঁজি করে সবার জন্য শান্তির দেশ গড়ার অঙ্গীকার করেন। সেই অঙ্গীকারের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ২৬ মার্চ, ১৯৭২ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া তাঁর ভাষণে। বরাবরের সেই তেজোদীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’ সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তাঁর জীবদ্দশার প্রতিটি মুহূর্তে। সুখী-সমৃদ্ধ যে বাংলাদেশ আজকে গোটা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের বিস্ময়, এর মূল ভিত্তি রচনা করে গেছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু।

স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশের অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, একটি আদর্শ সংবিধান রচনা, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইউজিসিসহ নানা প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন নিখুঁত দক্ষতায়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে ভেঙে পড়া অর্থনীতির চাকাকে ফের চালু করা, খাদ্য সাহায্য ও উৎপাদন নিশ্চিত করাসহ নানামুখী কর্মতত্পরতায় নিজেকে সর্বক্ষণ নিয়োজিত রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি জাতি গঠনে তিনি একের পর এক গ্রহণ করেছেন নানা কর্মপরিকল্পনা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় একটি শোষণমুক্ত, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেন তিনি। যেখানে বলা হয়েছে, এ দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য এবং সুবিচার নিশ্চিত করাই হবে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব।

দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য। স্বাধীনতা লাভের অল্প দিনের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ, পুরো দেশবাসীকে এ কাজে উজ্জীবিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেয়া পদক্ষেপগুলো আশাতীত সাফল্য অর্জন করে।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে মুক্ত হয়ে বিশেষ বিমানে পরের দিন ভোরে লন্ডন পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ৮ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি বৈঠক করলেন তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেন দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি। দিল্লিতে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতির সময় বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয় ভারত সরকার। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য ও লাখো ভারতবাসী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েই তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা একটি ছোট রাষ্ট্র, আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে এবং কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।’ এ ঘোষণাতেই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে। তিনি খুব ভালো করেই বুঝেছিলেন যে ভঙ্গুর অর্থনীতির এ দেশটি নিয়ে সবার সহযোগিতা ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। সেজন্যই তিনি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন।

একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ওই দেশের সম্পর্কের সমীকরণের ওপর। পররাষ্ট্রনীতির সফলতার জন্য শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেই চলবে না, এর সফল বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন শক্তিশালী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর দেয়া পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শনই হলো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান’ এবং জোটনিরপেক্ষ অবস্থান। এ কূটনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই আজকের বাংলাদেশ বিশ্বসমাজের সঙ্গে দৃঢ়তর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের সঙ্গেই রয়েছে বাংলাদেশের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এর ভিত্তিও রচনা করে গেছেন সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য ‘জাতির পিতা’ হিসেবে যা যা করার, তিনি তা-ই করে গেছেন। মাত্র দুই মাসের মাথায় বিদেশী সৈন্য ফেরত যাওয়া তাঁর কারণেই সম্ভব হয়। দেশের জন্য মাত্র ১০ মাসের মধ্যে তিনি একটি অপূর্ব শাসনতন্ত্র দিয়ে যান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন