ডেঙ্গু ও বন্যার কবলে ঈদ উৎসবের অর্থনীতি

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম ও সমাজে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও অবকাঠামো অবয়বে উদযাপিত উৎসবাদিতে মানবিক মূল্যবোধের সৃজনশীল প্রেরণা, সখ্য ও সৌহার্দ প্রকাশের অভিষেক ঘটে। নানা উপায় উপলক্ষে সম্প্রীতিবোধের বিকাশ লাভ ঘটে। অবনিবনার পরিবর্তে বন্ধন, মতপার্থক্যের অবসানে সমঝোতার পরিবেশ সৃজিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজা, দিওয়ালিসহ নানা পূজা-পার্বণে আত্মশুদ্ধি, অপয়া অসুর সত্তার সংহার ও সংবেদনশীলতার শুভ উদ্বোধন ঘটে। খ্রিস্টীয় বড়দিনের উৎসবে সংবৎসরের সব বিভ্রান্তি, বিবাদ-বিসংবাদ ভুলে অনাবিল আনন্দ আর আচার-অনুষ্ঠানে নিবেদিত হওয়ার সুযোগ সমুপস্থিত করে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সৎ চিন্তা, সৎ ধ্যান ও অহিংস অভেদ বুদ্ধি-বিবেচনার বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের পরিপালনীয় নির্বাণ অনুষ্ঠানাদিতে। সব আয়োজন ও আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো, সৃষ্টির সেবা ও সন্তুষ্টি বিধানের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত। সংহার নয়, সেবাই পরম ধর্ম। সব অশান্তি, কলহ ও বিবাদে শান্তির সম্ভাবনা শুধু সহযোগিতা-সমঝোতাতেই।

ধর্মীয় উৎসবগুলো সাধারণত বছরের বিশেষ সময়ে ও উপলক্ষে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ আসে, সংবৎসরের জমে থাকা দুঃখ-বেদনা-মনোমালিন্য দূর করার একটা উপলক্ষ তাতে মেলে। ধর্মীয় উৎসবগুলো প্রায়ই কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের প্রেক্ষাপটে আনন্দ ও ত্যাগের হেতু হিসেবে পালিত হয়। আত্মকল্যাণ লাভের জন্য কঠোর ত্যাগ, সাধনা ও পরিশ্রমের পর আনন্দের সোপান হিসেবে এ উৎসবের আয়োজন। সে উৎসবে থাকে পরিতৃপ্তির আমেজ। আত্মোৎসর্গের পরিতৃপ্তিতেই অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার ইচ্ছা জাগে। সেজন্য ধর্মীয় উৎসবগুলোয় দান-খয়রাত করা হয়। অর্থাৎ বিত্তবান, সামর্থ্যবানরা বিত্তহীন-অসমর্থদের সাহায্য করে, আনন্দে সবাই সমভাবে অংশগ্রহণ করে। অন্যের অতৃপ্তিকে নিজের অতৃপ্তি বলে মনে করে সবাই। খোদার সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আহার্য দ্রব্য, সম্পদ ও সামগ্রী এবং পবিত্র ঈদুল আজহায় জীবজন্তু উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গীকৃত এসব সম্পদ ও সামগ্রী, জীবজন্তুর কোনো কিছুই বিধাতার দরবারে সরাসরি পৌঁঁছে না। উৎসর্গকারীর পক্ষ থেকে নিবেদিত নিষ্ঠা ও সকৃতজ্ঞতা প্রকাশের ইচ্ছাটিই প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়।

সাম্য ও সামাজিক সংহতির ধর্ম ইসলামের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, আশুরা, শবেবরাত, শবেকদর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব উৎসবের মূল তাত্পর্য হলো আত্মশুদ্ধি ও আত্মোৎসর্গের কঠোর ত্যাগ সাধনার প্রেক্ষাপটে আনন্দঘন সম্মিলন। গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান-খয়রাত, ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে এ সম্মিলনে শরিক হওয়া, পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলি, কোরবানীকৃত পশুর মাংস বিলিবণ্টনের মাধ্যমে সামাজিকতার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’—এ মহান ব্রত বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুখময় জীবনযাপন নিশ্চিত হয়। ব্যষ্টি থেকে সমষ্টি। ব্যক্তিকল্যাণের ওপরই রচিত হয় সমষ্টিগত কল্যাণের সৌধ। পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন হয়। সামাজিক সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধ, যা অভিন্ন সত্তা হিসেবে কাজ করে। এ মূল্যবোধ সহসা কিংবা আরোপিত নির্দেশের বলে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও ব্যবহারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা স্থিতি আকারে প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ লাভ করে। এক্ষেত্রে ধর্ম এক বিরাট গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েই মানুষের জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে। ধর্মীয় অনুশাসনমালা মানুষের আচার-আচরণ, প্রবৃত্তি-প্রবণতার ওপর একটা গঠনমূলক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশ করে। মূলত ধর্মীয় বিধিবিধান, আচার-অনুষ্ঠান মানুষের আত্মিক উন্নতি লাভের পথনির্দেশ করে। আর এ আত্মগত উন্নতির ওপর ভিত্তি করে সমষ্টিগত তথা সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন