নদী বাঁচলে বাঁচব আমরা!

নাওরীন নূর, জুবায়ের আহমেদ, রাকিব বিন হোসেন, মাহি ওয়াসিম

পৃথিবীর বিখ্যাত ব-দ্বীপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যার পুরো ভিত্তি জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদী, ৭০০ নদী এবং উপনদীর সমন্বয়ে বাংলাদেশের রয়েছে সর্ববৃহৎ জলাশয়ভিত্তিক নেটওয়ার্ক। এ নদীগুলো জাতির ভূমিবৃত্তি ও মানুষের জীবন উভয়ই চিহ্নিত করে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দেশটি তার জলসম্পদ হারাচ্ছে। দেশের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা শহর বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা দিয়ে আবদ্ধ, কিন্তু এ নদীগুলো মানব ও শিল্পবর্জ্য দিয়ে ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, এ চার প্রধান নদী সাত হাজার শিল্প ইউনিট থেকে প্রতিদিন দেড় মিলিয়ন ঘনমিটার বর্জ্য জল এবং অন্যান্য উৎস থেকে আরো শূন্য দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনমিটার বর্জ্যে দূষিত হয়। এ দূষণের অন্তর্নিহিত কারণে নদীর অবাধ পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, নদীপথে যাতায়াতকারী যাত্রীদের ফেলে দেয়া বর্জ্যের ফলে নদীর পানি মানুষ ও প্রাণীদের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে ওঠে। বুড়িগঙ্গা নদীর ক্ষেত্রে, যা ‘ওল্ড গঙ্গা’ হিসেবে বিখ্যাত এবং দর্শনীয় দৃশ্য ও নদী ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয়, তা এখন নদীর তীরের কয়েক ডজন ট্যানারির বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সরকার নদী রক্ষার উদ্দেশ্যে এ ট্যানারিগুলো স্থানান্তর করার জন্য ২০১৭ সালে আদেশও পাস করেছে। তবে পরিবেশবাদীদের মতে, ট্যানারি মালিকরা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা লোককে ঘুষ দিয়ে এ জাতীয় নির্দেশ অমান্য করে ঠিকই নদীর তীরে তাদের ট্যানারি পরিচালনা করছেন। এদিকে বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ ও জল ব্যবস্থাপনার বিশেষজ্ঞ খাজা মিনাতুল্লাহ বুড়িগঙ্গা নদীকে মৃত নদী ঘোষণা এবং সেপটিক ট্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. সামসুদ্দোহা খন্দকার উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকা ওয়াসার ৭০ শতাংশ নর্দমা বর্জ্য সরাসরি নদীতে প্রবেশ করছে এবং বসিলা, শ্যামপুর, শোলমচি ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

তবে এ নদীগুলোকে দূষণকারীর হাত থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে, যেখানে সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে নদীর পানি দূষণ থেকে বাঁচাতে ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। বাংলাদেশ হাইকোর্টে আরেকটি ঐতিহাসিক বিচারকাজ সম্পাদিত হয় ৩ ফেব্রুয়ারি, যেখানে নদীগুলোকে আইনি সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং জলাশয়, খাল, বিল, উপকূল, পাহাড় এবং বনের অধিকার রক্ষায় তাদের অভিভাবক হিসেবে কাজ করার জন্য জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনকে (এনআরপিসি) আইনি অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের যেকোনো আদালত কর্তৃক নদী বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক সত্তার অধিকার রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনাসহ এটিই সবচেয়ে বিস্তৃত রায়।&dquote;&dquote;

আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বুড়িগঙ্গার মৃত্যুর মূল কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বুড়িগঙ্গাসহ আরো কিছু নদীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে ধারাবাহিক সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় নদী, জলাভূমি ও বন রক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা সঠিকভাবে সম্পাদনায় ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-তেও নদী রক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে অনেক ছোট নদীর মৃত্যু এরই মধ্যে জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সুতরাং সরকারের এখনই সময় নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে অবৈধ দখলদার থেকে নদীগুলোকে সুরক্ষা দেয়ার। নীতি ও বিধিমালা বাস্তবায়নের পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, যেমন—পানির গুণমান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ, জলাশয়গুলোকে দখল থেকে মুক্ত করা, পানিসম্পদ গবেষণা বৃদ্ধি করা, স্থানীয় পানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবি গ্রহণ, বিভিন্ন সেক্টরের পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, ভূগর্ভস্থ জলের স্রাব, প্রধান নির্মাণ প্রকল্প লেআউট এবং সামগ্রিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন। তবে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে পানির মোট ব্যবহারের পরিমাণ ৬৬০ বিলিয়ন ঘনমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এ উদ্যোগটি জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত এবং সে অনুযায়ী ব্যবহারগুলো সীমাবদ্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

 

নাওরীন নূর, জুবায়ের আহমেদ, রাকিব বিন হোসেন

মাহি ওয়াসিম: নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন