ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক প্রতি বছর একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়

বন্যা ও বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-রেলে মেরামত কার্যক্রমের মধ্যেই শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা। চলমান অবস্থায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি। বাড়ছে যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। এর মধ্যে হঠাৎ শুরু হওয়া বৃষ্টিতে নৌপথের যাত্রা যেমন নির্বিঘ্ন হচ্ছে না, তেমনি বাস ও ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ১৫১ কিলোমিটার সড়ক এখনো বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। তাছাড়া চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১ জেলায় ৬৩৫ কিলোমিটার সড়ক। এমনিতে সড়কে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির জন্য দায়ীদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি, এর সঙ্গে রেল ও নৌপথের অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলতা দিন দিন বাড়ছে। সব মিলিয়ে এবার ঈদে ঘরে ফেরা যাত্রীদের ঝুঁকি ও ভোগান্তির মাত্রা বেড়েছে কয়েক গুণ। যদিও ঈদের অন্তত তিনদিন আগে বন্যা ও বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক মেরামত সম্পন্নের নির্দেশনা ছিল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। সে হিসাবে গতকালের মধ্যেই মেরামতের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো চিত্রই দৃশ্যমান। ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ সড়কেই দায়সারাভাবে সংস্কারকাজ চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাই বিগত সময়ের মতো এবারো উৎসবে বাড়ি ফেরা ঘিরে দুর্ভোগই সঙ্গী সাধারণ মানুষের।

এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ঘাটে আটকা পড়েছে কয়েকশ যানবাহন। তাছাড়া ভাঙাচোরা সড়কে স্বাভাবিকভাবেই দ্রুতগতিতে যান চলাচল সম্ভব হবে না। যাত্রাপথে অতিরিক্ত সময় নষ্টের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চালকরা যদি গতি বাড়িয়ে দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হবে। সরকারি হিসাবে চলতি বন্যা ও বৃষ্টি শুরুর আগে ৪ হাজার ২৪৫ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা বেহাল ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৭০১ কিলোমিটার রাস্তা। সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কে সমস্যা বিদ্যমান। অতীতের উদাহরণ অনুসারে আপত্কালীন সংস্কারেই মনোযোগী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর ধরে এমন দায়সারা কাজের প্রক্রিয়াটি যদি বন্ধ করা না হয়, তবে গণমানুষের ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতির মাত্রা বেড়েই চলবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঈদযাত্রাকে স্বাভাবিক ও ভোগান্তিহীন করতে আগে থেকে পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। মাঠ পর্যায়ে শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা যেত। যদিও বন্যার পানির নিচে থাকা সড়কগুলো মেরামত সহজ নয়। তবুও পানি নামার পর পরই সেগুলো সংস্কারে মনোযোগী হওয়া যেত কিংবা ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা যেত। বিশেষ করে বন্যার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মহাসড়কের উচ্চতা বাড়ানো এবং টেকসই নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ কাজে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের পরামর্শ গ্রহণপূর্বক বিটুমিনের বদলে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণে গুরুত্ব দিতে হবে। বিটুমিনের তৈরি সড়কের চেয়ে কংক্রিটের তৈরি সড়ক বেশি টেকসই। এতে নির্মাণ ব্যয়ও কম হয়। বন্যা ও বৃষ্টির পানিতে বিটুমিনের সড়ক যেখানে ভঙ্গুর হয়, সেখানে কংক্রিটের সড়ক তুলনামূলক টেকসই থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে কংক্রিট শক্তি পায় আর বিটুমিন শক্তি হারায়। এজন্যই বর্ষায়, জলাবদ্ধতায় বিটুমিনের তৈরি সড়কের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া রাস্তা দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে নির্মাণকালীন মনিটরিং এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষার অভাবও দায়ী। ওভারলোডেড বাস-ট্রাক চলাচলের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে কাজের মান উন্নয়নের দিকেও। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা উচিত। উন্নত বিশ্বে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত বৃষ্টির পানি শোষণের প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। উদাহরণটি আমরা অনুসরণ করতে পারি। 

শঙ্কা রয়েছে রেল যোগাযোগ ঘিরেও। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের অব্যবস্থাপনা, রেল প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতা, ১০০ বছরের পুরনো সেতু, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, পাথর ছাড়া রেলপথ, সংস্কারবিহীন পুরনো রেললাইনের কারণে রেলপথে ঝুঁকি ক্রমেই ভয়াবহ মাত্রা নিয়েছে। যোগাযোগ খাতে বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিলেও অবস্থার দৃশ্যমান উন্নতি ঘটানো কেন সম্ভব হচ্ছে না, তা যাচাই করা জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ, বাস মালিক-শ্রমিক ও বিআরটিএকে পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। যাত্রাপথের ভোগান্তি কমাতে সড়ক-মহাসড়কের দুর্বল পয়েন্টগুলো দ্রুততম সময়ে মেরামত করা জরুরি। যে মহাসড়কে উন্নয়নের কাজ চলছে, সেখানে যান চলাচল যাতে বিঘ্নিত না হয়, তা আমলে রাখতে হবে। সর্বোপরি চালকদের বিশৃঙ্খল ও বেপরোয়া যান চালনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। চালকদের নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি সড়কে নির্দিষ্ট দূরত্বে হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিষয়টিও। বেহাল সড়ক ও অব্যবস্থাপনার কারণে যেন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সেদিকে কর্তৃপক্ষের মনোযোগ দেয়া জরুরি। 

ঈদযাত্রা ঘিরে প্রতি বছরই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সড়ক-মহাসড়কে ছোটখাটো সংস্কার করে যান চলাচলের উপযোগী করার প্রক্রিয়া চলে। ঈদযাত্রা নিরাপদ হবে, মানুষের ভোগান্তি হবে না—এমন ঘোষণা সত্ত্বেও ঈদের দু-তিনদিন আগে থেকেই মহাসড়ক স্থবির হয়ে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদি ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা নেই বলে উৎসবযাত্রা সীমাহীন ভোগান্তির হয়ে ওঠে। অথচ যথাযথ পরিকল্পনা, সমন্বয় ও চেষ্টা থাকলে সত্যিকার অর্থে বিষয়টিকে স্বাভাবিক করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতনতা ও তত্পরতার মাধ্যমে এর রাশ টানা যাবে বলেই আমরা মনে করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন