রকেটে চড়ে নানান দেশ!

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

একদা স্বচ্ছ টলটলে স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গার পানি পচে বাতাসে উত্কট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিছুটা সময় চলার পর ধলেশ্বরী নদীতে জাহাজ যেতেই নির্মল বাতাসের ছোঁয়া পেলাম। যে বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে রাজধানী গড়ে উঠেছিল, নবাব মহাশয়রা নদীর তীরে তাদের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন। আর আজ কিনা সেই বুড়িগঙ্গায় নৌ ভ্রমণে নাক চেপে ধরতে হয়

আ মার জন্মস্থান আদি ঢাকার বাদামতলী। রকেট স্টিমার ঘাট থেকে বাড়ির দূরত্ব ছিল মাত্র ১ মিনিটের হাঁটার পথ। স্টিমারের হুইসেলের আওয়াজ ছিল নিত্য সঙ্গী। দুরন্তপনার কৈশোর ও তরুণ বয়সের অনেকটা সময়ই কেটেছে রকেট স্টিমার গাজী, টার্ন, লেপচা, মাসুদ, অস্ট্রিচ, কাজল, শহিদ বেলায়েত নামক জাহাজের ছাদে, বারান্দা আর কেবিনে আড্ডা দিয়ে। বর্ষার সময় বাল্যবন্ধু আতিক, স্বপন, বিপ্লবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে কতবার যে স্টিমারের ছাদ থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়েছি, তার ইয়াত্তা নেই; আর আমিনুল ইসলামের পাগলামির বর্ণনা লিখে শেষ করার নয়। সে অন্ধকার রাতেও ভরা বর্ষায় প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যে বীরত্ব দেখাতে নদীতে ঝাঁপ দিত। আজ সবই স্মৃতি। ঘাটে যখন জাহাজ ভিড়ত কিংবা ছেড়ে যেত, তখন কত রঙের মানুষের দেখা মিলত। জাহাজে আড্ডা দেয়ার সুবাদে প্রায় সব স্টাফের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে এলাকার বড় ভাই ছাবের, তার কর্তৃত্ব এখনো আছে স্টিমার ঘাটে। সে কারণে বাড়তি সুযোগ ছিল জমপেশ আড্ডা জমানোর। আজ আর আড্ডা দেয়া হয় না, তবে ছোট্ট থেকেই মনের  ভেতর শখ ছিল জাহাজে ভ্রমণের। কিন্তু সময়-সুযোগের অভাবে হয়ে ওঠেনি। তবে রকেট স্টিমারে ভ্রমণে প্রতিনিয়ত শখ ছিল। অবশেষে চলে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিশেষ কারণে দুদিনের জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ঠিক তার আগের দিন অস্ট্রিচ জাহাজের প্রধান ইঞ্চিন কর্মকর্তা লোকমান হোসেন আমার বিজনেস ফার্মে এসে হাজির। কথাপ্রসঙ্গে ভদ্রলোক অফার করে ফেললেন আগামীকাল বেলা সাড়ে ৩টায় বাদামতলী  থেকে জাহাজ ছাড়বে, চলুন ঘুরে আসবেন। মোক্ষম সময়ে উপযুক্ত প্রস্তাব হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না। রাতের মধ্যেই দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের একজনকে সঙ্গী করে নিলাম। পরের দিন সে যথাসময়ে এসে হাজির, আমিও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে অস্ট্রিচ নামক জাহাজে চড়লাম। শৈশবের বহু স্মৃতি এ জাহাজ ঘিরে। ফার্স্ট ক্লাস এসি কেবিন ৫ নং আমাদের জন্য বুকিং করা হয়েছে। কেবিনের ডেকোরেটিভ বেশ চমত্কার। জাহাজ ছাড়ল ৬টা ৪০ মিনিটে। নির্ধারিত সময় থেকে ১০ মিনিট লেট। পরে জানতে পেরেছি ১০ মিনিট দেরিতে ছাড়ার কারণের মহানায়ক আমি। খানিকটা অপরাধী মনে হয়েছে নিজেকে। সময়জ্ঞান সম্পর্কে সবারই সচেতন হওয়া জরুরি। একদা স্বচ্ছ টলটলে স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গার পানি পচে বাতাসে উত্কট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিছুটা সময় চলার পর ধলেশ্বরী নদীতে জাহাজ যেতেই নির্মল বাতাসের ছোঁয়া পেলাম। যেই বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে রাজধানী গড়ে উঠেছিল, নবাব মহাশয়রা নদীর তীরে তাদের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন। আর আজ কিনা সেই বুড়িগঙ্গায় নৌ ভ্রমণে নাক চেপে ধরতে হয়। সত্যিই দুর্ভাগা জাতি আমরা, সচেতনতার অভাবে নদী পরিণত হয়েছে ড্রেনে। লোকমান সাহেব নাশতার এন্তেজাম করলেন। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর ফিশ কাকলেট। রকেট স্টিমার হুইসেল ছেড়ে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুর ঘাটের দিকে। আমি পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। মনে পড়ে শৈশবে ডুবসাঁতারে অংশ নেয়া অনেক বন্ধুর কথা। রাতের ডিনার শেষে ইঞ্চিন কর্মকর্তার কেবিনে গিয়ে বসলাম। বিভিন্ন &dquote;&dquote;আলাপচারিতার মধ্যে আমরা আমাদের ভ্রমণসূচি ঠিক করে নিলাম। প্রাথমিকভাবে সিন্ধান্ত ছিল অস্ট্রিচ জাহাজেই যাব, আবার এ জাহাজেই ফিরব। অর্থাৎ জাহাজেই সময় কাটাব। কিন্তু বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ ও হজরত খানজাহান আলীর (র.) মাজারে যাওয়া এবং জিয়ারত করা হয়নি; তাই সিদ্ধান্ত ত্বরিত পাল্টালাম। উড়োজাহাজ থেকে লক্ষগুণে আরামদায়ক নৌ-জাহাজে একটা ফ্রেশ ঘুম দিয়ে পরের দিন সকাল ১০টায় হুলার হাট নেমে পড়লাম। তবে ভ্রমণপিপাসুদের উদ্দেশে একটি কথা না লিখলেই নয়! কাউখালী বন্দরে ভেড়ার আগে জাহাজ গাবখান চ্যানেল যখন ক্রস করে, তখন যেকোনো নীরস ব্যক্তিও দুই পাশের প্রকৃতি দেখে বেশ উত্ফুল্ল হবে। মনে হবে অবারিত সবুজের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে কোনো এক ভূস্বর্গের পানে। হুলার হাট নেমে তিন চাকা বাহনে পিরোজপুর শহরে। উদ্দেশ্য নদীমাতৃক শহর পিরোজপুরে কিছুটা সময় ঘুরব। কিন্তু বাধ সাধে রাজনৈতিক কর্মসূচি। নতুন এলাকা পুলিশি ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা, তাই ঢাকা মাস্টার টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী মানিকের শরণাপন্ন হলাম। তিনি একজন ডিবি পুলিশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরতে বললেন। ধন্যবাদ তার সহযোগিতার ?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন