বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ইউনাইটেড পাওয়ারের শেয়ার কিনছে

 

গেল বছর গ্রুপের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র অধিগ্রহণ করেছে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ইউপিজিডিসিএল)। গত বৃহস্পতিবার পর্ষদ সভায় সর্বশেষ সমাপ্ত ২০১৮-১৯ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুমোদন করেছে বিদ্যুৎ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নতুন যোগ হওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস), রাজস্ব, পরিচালন মুনাফা এবং কর-পরবর্তী মুনাফায় ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সম্প্রতি ইউপিজিডিসিএলের আর্থিক ও ব্যবসায়িক বিভিন্ন দিক নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনউদ্দিন হাসান রশিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

নতুন তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র অধিগ্রহণের কারণেই কি ইউপিজিডিসিএলের রাজস্ব ও মুনাফায় ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে?

আমরা সবসময় শেয়ারহোল্ডারদের সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করি। গত বছর আমরা ২৭৬ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্রুপের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে অধিগ্রহণ করি। এর ফলে সদ্যসমাপ্ত ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে আগের বছরের তুলনায় শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) ৮৫ শতাংশ, রাজস্ব ৮৩ শতাংশ, পরিচালন মুনাফা ৮৮ শতাংশ এবং কর-পরবর্তী মুনাফায় ৭১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর ফলে এবার আমরা শেয়ারহোল্ডারদেরও লভ্যাংশও বেশি দিয়েছি। ২০১৮ সালে আমরা ৯০ শতাংশ নগদ ও ২০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছি। আর এবার ১৩০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছি। আমরা নগদ লভ্যাংশ বেশি দেয়ার চেষ্টা করি, যাতে শেয়ারহোল্ডাররা আমাদের মুনাফার ভাগ যথাসম্ভব বেশি পায়।

সম্প্রতি ইউনাইটেড এনার্জির মালিকানাধীন আশুগঞ্জের ৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে...

ইউপিজিডিসিএলের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এনার্জি লিমিটেডের মালিকানায় আশুগঞ্জে যে ৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র্র রয়েছে, সেটির সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চুক্তির মেয়াদ চলতি বছরের ২২ জুন শেষ হয়েছে। এ মেয়াদ আরো বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। তবে এ কেন্দ্রটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে এর প্রভাব যাতে শেয়ারহোল্ডারদের ওপর না পড়ে, সেজন্য আমরা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি লেভিয়াথান গ্লোবাল করপোরেশন ও ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ মালিকানাধীন ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৭৫ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ মাসের শেষের

দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে। বর্তমানে আমরা চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেডে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি চাহিদা তার চেয়ে বেশি। ৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হলে ৩০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ আমরা দুই ইপিজেডে সরবরাহ করতে পারব। আর বাকি ২০ মেগাওয়াট গ্রিডে সরবরাহ করব। ভবিষ্যতে গ্যাস পেলে উৎপাদন আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। খেয়াল করে দেখুন, একদিকে ৫৩ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে, অন্যদিকে আমরা ৫০ মেগাওয়াটের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের শেয়ার কিনে নিয়েছি, যাতে কোম্পানির রাজস্ব ও মুনাফায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। আমরা সবসময় শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের কথা চিন্তা করি। ইউনাইটেড পাওয়ারের শেয়ারে বিনিয়োগের টাকা শেয়ারহোল্ডাররা এরই মধ্যে ফেরত পেয়েছেন।

এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন...

২০১৫ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে যেসব বিনিয়োগকারী আমাদের শেয়ার কিনে এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছেন আমরা হিসাব করে দেখেছি যে তারা তাদের বিনিয়োগ করা টাকা এরই মধ্যে ফেরত পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত আমরা শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারপ্রতি ৫১ টাকার মতো নগদ লভ্যাংশ দিয়েছি। অন্যদিকে আমাদের প্রতি শেয়ারে শেয়ারহোল্ডারদের বিনিয়োগ ছিল ৪৮ টাকা। এর ফলে তারা সবাই বিনিয়োগের চেয়ে বেশি নগদ লভ্যাংশ পেয়েছেন। এখন শেয়ারের যে ভ্যালু রয়েছে এর পুরোটাই শেয়ারহোল্ডারদের লাভ। এটি অবশ্য যেসব শেয়ারহোল্ডার শুরু থেকে ইউনাইটেড পাওয়ারের শেয়ার ধরে রেখেছেন তাদের জন্য প্রযোজ্য। এভাবেই আমরা সবসময় শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ভ্যালু অ্যাড করার চেষ্টা করছি।

আপনারা সম্প্রতি জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ অর্থ কী কাজে ব্যয় হবে?

১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকার জিরো কুপন ইসলামিক সার্টিফিকেট বন্ড থেকে ৮৫০ কোটি টাকার মতো পাওয়া যাবে। ইউপিজিডিসিএলের সাবসিডিয়ারি ইউনাইটেড আশুগঞ্জ এনার্জি এবং গ্রুপের সহযোগী কোম্পানি ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ারের বিদেশী ঋণ পরিশোধের জন্য এ অর্থ ব্যয় হবে। এতে আমাদের আর্থিক ব্যয় কমবে এবং মুনাফায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির আওতায় কত মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। আর ইউনাইটেড গ্রুপের আওতায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কত?

তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউপিজিডিসিএলের আওতায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৪৩০ মেগাওয়াট। এ বছর এর সঙ্গে আরো ৫০ মেগাওয়াট যোগ হবে। এর পুরোটাই গ্যাসভিত্তিক। আর তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও খুলনা পাওয়ার বাদে ইউনাইটেড গ্রুপের আওতায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বর্তমানে ৬১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এগুলো সবই এইচএফওভিত্তিক। তাছাড়া খুলনা পাওয়ারের ১৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। এর বাইরে পাইপলাইনে আরো বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের অন্য কোম্পানির তুলনায় ইউপিজিডিসিএলের মুনাফা মার্জিন বেশি হওয়ার কারণ কী?

আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। তাছাড়া আমাদের কেন্দ্রগুলোর দক্ষতা বেশি। আমরা প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই কো-জেনারেশনের মাধ্যমে কোনো ধরনের খরচ ছাড়াই বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। তাছাড়া আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো বিদেশী বিশেষজ্ঞ নেই। স্থানীয় প্রকৌশলীদের নিয়েই আমরা কাজ করছি। এতেও আমাদের ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি বেশি রিটার্ন পাচ্ছি। আর এসব কারণেই আমাদের মুনাফা মার্জিন বেশি।

কো-জেনারেশনের বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন...

আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে তেল ও গ্যাস পোড়ানোর পরে যে তলানি থাকে, সেটি ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বের হয়। এটিকে কাজে লাগিয়ে আমরা স্টিম উৎপাদন করে সেটা ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে সরবরাহ করছি। আমাদের এইচএফওভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে কো-জেনারেশনের মাধ্যমে ৬ থেকে ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ কোনো ধরনের জ্বালানি ছাড়াই উৎপাদন করা হচ্ছে। আর আমাদের এ দক্ষতার কারণে কিন্তু বিশ্বব্যাংক, ডিএফআইডির মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অর্থায়ন পেতে সুবিধা হচ্ছে।

কী ধরনের সুবিধার কথা বলছেন?

একে তো আমাদের ট্র্যাক রেকর্ড বেশ ভালো। তার ওপর দক্ষতার কারণে আমরা যখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অর্থায়নের জন্য যাই, তারা ভালো সাড়া দেয়। এমনকি অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম সুদে এবং বেশি মেয়াদের জন্য আমরা ঋণ পাই। এটি অনেক বড় সুবিধা। ২০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আপনি যদি ২ শতাংশ ব্যয়ও কমাতে পারেন সেটি কিন্তু অনেক।

বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে একটি ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে...

স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব প্রতিষ্ঠানেরই অভিজ্ঞতা বাড়ছে। আর তাই সবাই এখন ছোট আকারের চেয়ে মধ্যম ও বড় আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে। তাছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে এইচএফও বদলে এলএনজির ব্যবহার বাড়ছে।

আপনাদের ভিশন কী?

আমরা ভবিষ্যতে একটি বড় আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চাই। ন্যূনতম ৬০০ মেগাওয়াটের একটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ইচ্ছা রয়েছে।

বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ইউপিজিডিসিএলের শেয়ার কিনতে চাইছেন?

আমাদের কোম্পানির সার্বিক পারফরম্যান্সের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বেশ কয়েকজন আগ্রহ দেখালেও আমরা স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য আমাদের কাছে থাকা শেয়ার থেকে ৫ শতাংশ ছেড়ে দেব এবং বিদেশী প্রতিষ্ঠানটি ব্লক মার্কেটে তা কিনে নেবে। তবে এর সবকিছুই বিদ্যমান সিকিউরিটিজ আইন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গাইডলাইন অনুসারে সম্পন্ন হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন