বাংলাদেশেও কি পরিবেশ বাণিজ্য সম্ভব?

চারু ফেরদৌসী নাঈমা

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে গ্রিস। অন্তত পরিবেশ উন্নয়নে। গত ১০ বছরে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশটির দুর্ভাগ্যের মূলে রয়েছে পাসোক নেতাদের লুটপাট, অর্থনৈতিক বাজেটে ক্রমবর্ধমান ডেফিসিট চাপা দেয়া, লাগামহীন বিলাসিতা এবং ইইউর দূরদৃষ্টির অভাব। কিন্তু বামঘেঁষা রাজনৈতিক দল সিরিজার উত্থানে গ্রিস শেষ পর্যন্ত লাভবানই হয়েছে বলা যায়। দেশটির উন্নয়ন সূচক মাঝারি অবস্থানে স্থির রয়েছে, যা কেবল উঠে দাঁড়ানো গ্রিসের সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের ভারসাম্যের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়। যা কিছু ধীরে ধীরে আসে তা-ই সত্যিকারের সৌভাগ্য। গ্রিস এ মুহূর্তে বিদেশে এমনকি সুদূর বাংলাদেশেও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী। নবায়নযোগ্য শক্তি, জাহাজ তৈরি ইত্যাদিতে তাদের প্রস্তাবিত এ উদ্যোগ গ্রিস ও বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

একসময় একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ খবর প্রচারে আগ্রহী ছিল যে চীনের বাজারের বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য। অথচ চীন ঠিকই তার নিজের স্বার্থে যা করার তা করে যাবে, তাই বাংলাদেশকে নিজের যা করার তা করতেই হবে। পশ্চিম ও পূর্বের দ্বন্দ্ব একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যেখানে পরিবেশ বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন হাতে হাত মিলিয়ে উভয়ের যুদ্ধ করাটাই সমীচীন নয় কি? নইলে ক্ষতিগ্রস্ত হব শুধু আমরা নই, সবাই। এখনো যখন চীন লাগামহীনভাবে প্লাস্টিক পণ্যে বাজার সয়লাব করে যাচ্ছে এবং সেগুলোর রিসাইকেলের কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না, সে মুহূর্তে গ্রিস তার জেলেদের ২০০ ইউরো অর্থাৎ ২০ হাজার টাকা প্রতি মাসে দিচ্ছে কেবল জালে আটকে পড়া প্লাস্টিক সাগরে না ফেলতে। সেগুলো ধরে রাখা হচ্ছে সাগর পরিষ্কারে ও রিসাইকেলে।

প্রকৃতি পরিচ্ছন্ন রাখতে কেউ আপনাকে টাকা দেবে না। এতদিন তা ছিল কেবল আপনার নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এ পরিবেশ ফান্ড, যা গ্রিস সরবরাহ করছে, তা কি কেবলই দান মনে হচ্ছে আপনার চোখে? তা সম্ভব নয়। বরং এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, গ্রিস সবুজ অর্থনীতির পরিবেশ বাণিজ্যে বিনিয়োগ করছে, যার পরিণতি হিসেবে আমরা এ ধরনের পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি। গ্রিস এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পরিবেশ উন্নয়নেও তারা এখন ব্যবসার উদ্যোগ নেবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, তারা বাংলাদেশেও বিনিয়োগে আগ্রহী। আমরা কিন্তু সহজেই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বা অভ্যাসবলে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি; এবং সেটা যদি হয় একটি ভোগ্যপণ্য তাহলে অনেক বেশি সবুজ বরং আমরা সংরক্ষণ করতে পারব। এ ব্যাপারে গ্রিস ও বাংলাদেশ উভয়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

গ্রিস বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু যদি পরিবেশেও তাদের ওই উদ্যোগ এ দেশে প্রসার ঘটাতে পারে তাহলে গ্রিসও যেমন লাভবান হবে, বাংলাদেশও পরিচ্ছন্ন সবুজ কেবল বাণিজ্যের মাধ্যমে লাভ করে বরং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির প্রসার ঘটাতে পারবে। এখন বাংলাদেশ তার ব্যাংকিং খাতে লুটপাট ঠেকাতে ব্যস্ত। বাংলাদেশ গ্রিসের মতো দেউলিয়া হওয়া তখনই ঠেকাতে সক্ষম হবে, যদি আগেই বৈশ্বিক বাণিজ্যের সাইকেলের মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে নিতে পারে। বাংলাদেশ অবশ্যই এর আওতায় রয়েছে কিন্তু পরিবেশ বাণিজ্য থেকে এখনো বহুদূরে।

গ্রিসের অর্থনীতি এখন বিশ্বের অর্থনীতির ভরকেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। প্রায়ই সংবাদ শোনা যাচ্ছে যে সবার আগে উন্নতি সূচক গ্রিসে পাওয়া যাচ্ছে। যে পরিস্থিতিকে অনুসরণ করছে ইউরোপের অন্যান্য বাজার। তারা হয়তো অন্যভাবে আরো এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু গ্রিস ততক্ষণে তার মোড় ঘুরিয়ে ফেলছে। করপোরেট অর্থনীতিতে তাদের নতুন উদ্যোগের প্রভাব এতই বেশি ও ফলপ্রসূ যে বিশ্বের জিডিপি তাদেরই ফিরে জোগান দিচ্ছে। এ অবস্থায় তারা যখন পরিবেশের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে তখন নিঃসন্দেহে বলা যায়, পরিবেশ বাণিজ্য এখন চারাগাছের মতো নতুন কুঁড়ি মেলছে এবং দ্রুত বাড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে এ বাণিজ্যের প্রসার দ্রুত ফলপ্রসূ হতে পারে। কারণ এ দেশে পরিচ্ছন্ন সবুজের চাহিদা রয়েছে।

খুবই উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, ২০৫০ সালের দিকে সমুদ্রে মাছের ওজন ছাড়িয়ে ফেলবে সব প্লাস্টিক বর্জ্য (দ্য গার্ডিয়ান, ৩০ মার্চ, ২০১৯)। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একাধিক এলাকাজুড়ে হাজার হাজার বর্গমাইলব্যাপী রয়েছে বিশাল বর্জ্য এলাকা, যেখানে প্লাস্টিকই শুধু ভেসে বেড়াচ্ছে। প্লাস্টিক পরিষ্কার অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। অন্তত এতদিন ছিল না। কিন্তু গ্রিস নতুন পথ দেখাচ্ছে যে কীভাবে আমরা সমুদ্র পরিষ্কার রাখতে পারি। বিশ্বব্যাপী নানা সংস্থা কাজ করছে এ ব্যাপারে। কিন্তু পরিবেশ বাণিজ্য একটি ভিন্নপথ।

সবুজ জিডিপি বলে একটি সূচক রয়েছে, যেটির হার বাংলাদেশে খুব বেশি নয় এখন পর্যন্ত। পরিবেশসংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগ ও অর্থনীতির যে অংশটি এর সচেতনতায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সূচনা করে, সবই এর পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার হয়। যেখানে সিঙ্গাপুরের একটি নদীতেও কলার খোসা ফেলা যায় না, সেখানে আমরা বাংলাদেশে ওভারব্রিজের ফুলের টবে কলার খোসা দিব্যি পড়ে থাকতে দেখি। যে মানুষ আজ যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের বোতল ফেলে দিচ্ছে, সে মানুষ যে দেশে পরিবেশ রক্ষায় নিয়ম আছে, সেখানে নিয়ম মেনে যথা জায়গায় বর্জ্য ফেলছে। এটা কেন? কারণ আমাদের দেশে এখনো পরিবেশ বিনিয়োগ কোনো স্থান পায়নি এবং তা সবার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আইন থাকলেও তার প্রয়োগে কড়াকড়ি নেই এবং যথেষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই বলে আমরা নদীর ধারেও দেখি বর্জ্যের স্তূপ। এর বেশির ভাগই প্লাস্টিক। মানুষ জৈব বর্জ্যও নদীতে নিষ্কাশন করতে অক্ষম, কারণ তা দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং নদীর ধারে যে বাজার রয়েছে তার পরিবেশ ও হাওয়ার জন্য দূষণ উৎপাদন করে। আমাদের দেশে একটি নদীও নেই, যার ধারে ময়লা ফেলার আধার রয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের দেশে নদীকেই ড্রেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ অথচ সব নদীকেই আমরা দূষণ নিষ্কাশনের আধাররূপে ব্যবহার করছি এবং কারখানার যত বিষাক্ত বর্জ্য ড্রেনের মতো সরাসরি সেখানে ফেলছি। এ অবস্থা আমাদেরই শোধরাতে হবে। যদি আইন দিয়ে সম্ভব না হয়, তবে বাণিজ্যের মাধ্যমে। গ্রিস আজ তার দ্বীপগুলোকে একে একে প্লাস্টিকমুক্ত ঘোষণা করছে এবং বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক অর্থাৎ পচনশীল প্লাস্টিক বাজারজাত করার মাধ্যমে প্লাস্টিকদূষণ কমাচ্ছে। আমাদেরও রয়েছে ‘সোনালি ব্যাগ’। যদি নানা ডিজাইনের এ ব্যাগ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তবে তাও হবে সবুজ বাণিজ্য প্রসারে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ। এমনকি এ ব্যাগ রফতানিও হতে পারে, যদি অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাংলাদেশ মিটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন দূরদর্শী পদক্ষেপ। এখনই বৈদেশিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পরিকল্পনায় আসা উচিত পরিবেশ বাণিজ্যের প্রসার বাংলাদেশে কীভাবে হবে।

বাংলাদেশের উচ্চ জনসংখ্যার চাপ পরিবেশ বিষয়ে একটি ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, যেটা অনায়াসেই একটি চাহিদায় পরিণত হতে পারে যদি আমরা পরিবেশ বিষয়ে এভাবে উদ্যোগী হই। পরিবেশ কর, পরিবেশ আইন, পরিবেশ শিক্ষা এগুলোই যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না এটি একটি পণ্যে রূপান্তর হচ্ছে। সারা বিশ্বের বাজার অর্থনীতিতে পরিবেশও একটি বৃহৎ সাড়া ফেলবে যখন সবুজ সংরক্ষণে পরিবেশ করপোরেট গজিয়ে উঠবে এবং ইকো কারেন্সি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিময় হিসেবে ব্যবহার হবে। এখন ক্রিপ্টো কারেন্সির যুগ। কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতে গ্রিন কারেন্সিও ক্রিপ্টো কারেন্সির একটি মাধ্যমে পরিণত হবে। রিসাইকেলের বিরাট ব্যাপার হচ্ছে, এটি কেবল শুরু করতে হবে তা-ই নয়, এটি কোনো দিন শেষও হবে না। এর গতি আমাদের ধরতে হবে। যে জাতি বা দেশ আগে উদ্যোগী হবে, তারাই যে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করবে, তাতে সন্দেহ নেই।

 

চারু ফেরদৌসী নাঈমা: প্রকৌশলী

পরিচালক, দূষণমুক্ত প্রযুক্তি

জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন