লোকসানের আবর্তে বিজেএমসি

দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে ব্যর্থ হচ্ছে উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংকটের অতলে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে পাটশিল্পের রাষ্ট্রায়ত্ত অংশটি। প্রতি বছরই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে থাকে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। একইভাবে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা থেকেও অনেক পিছিয়ে সংস্থাটি। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে এর দায়-দেনা। প্রতি বছরই বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। বিজেএমসি চালু থাকবে, না বন্ধ করা হবে, সেটি নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়, বিজেএমসিকে টিকিয়ে রাখার জন্য গৃহীত সব উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখছে না মূলত অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে।

গত ১৬ মে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিজেএমসির ওপর প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কাঁচা পাট ক্রয়, পাটপণ্য উৎপাদন এবং বিদেশে ও স্থানীয় বাজারে ওই পণ্য বিক্রি—সব ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে বহুদূরে বিজেএমসি। প্রতিবেদনটি নিয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ধারাবাহিক লোকসানের কারণ হিসেবে বিজেএমসি অর্থ সংকট ও মজুরিজনিত ব্যয়ের কথা উল্লেখ করেছে। তবে কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, পাট খাতের উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্যোগ নিয়ে চলেছে সরকার। তবে দুর্নীতি ও অদক্ষতার জন্য সেসব উদ্যোগ কাজে আসছে না।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জামালপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত মির্জা আজম। তিনি গত মেয়াদে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বৈঠকে তিনি বলেন, বিজেএমসি চালু থাকবে, না বন্ধ করা হবে, সে বিষয়ে সবার আগে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। বিজেএমসি বন্ধ করতে গেলেও তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে, আবার লোকসান থেকে ব্রেক ইভেনে আসতেও কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে।

বিজেএমসি বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিজেএমসি জন্মলগ্ন থেকেই লোকসান দিয়ে আসছে। তার পরও বেসরকারি খাতের একচেটিয়া ব্যবসা ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব বন্ধ করা সর্বোপরি পাট ও কৃষকের স্বার্থে বিজেএমসিকে টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।

বৈঠকে কমিটির সদস্য মো. ইসরাফিল আলম বলেন, পাটকল খাতে বাস্তবমুখী সামগ্রিক সংস্কার করা না হলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ খাতের ষাট-সত্তর হাজার শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার স্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে অবিবেচনাপ্রসূত অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রয়োজনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অ্যাডহক বা অস্থায়ী শ্রমিকরা যেহেতু স্থায়ী কাঠামোর বাইরে তাই তাদের ছাঁটাই করার বিষয়ে দ্রুত বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বিজেএমসিকে বাঁচাতে হলে ছয় মাসের জন্য বিজেএমসি বন্ধ রেখে অস্থায়ী শ্রমিকদের ছাঁটাই কার্যক্রম কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার পক্ষে তিনি মত ব্যক্ত করেন।

বৈঠকে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকরা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে যেতে ইচ্ছুক। এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। তিনি সার্বিক বিষয়ে অর্থমন্ত্রী, অর্থসচিব ও সিবিএ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য স্থায়ী কমিটির সভাপতিকে অনুরোধ জানান।

বর্তমানে বিজেএমসির পাটকলগুলোয় মোট তাঁতের সংখ্যা ১০ হাজার ৮৩৫টি। এর মধ্যে চালুর উপযোগী তাঁত ৯ হাজার ৫৫২টি। আর অকেজো হয়ে আছে ১ হাজার ২৮৩টি। যদিও বিদ্যমান সক্ষমতার সবটুকু কাজে লাগাতে পারছে না সংস্থাটি। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজার ৭৩৪টি বাজেটেড তাঁতের মধ্যে চালু ছিল ৪ হাজার ৩৮৯টি।

২০১৯ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ বছরে বিজেএমসির মোট লোকসান ৩ হাজার ৮০৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ সালে লোকসান ২৯৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, ২০০৯-১০ সালে ২২০ কোটি ৩১ লাখ, ২০১১-১২ সালে ৬৬ কোটি ৩৯ লাখ, ২০১২-১৩ সালে ৩৮৪ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১৩-১৪ সালে ৪৯৬ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১৪-১৫ সালে ৭২৬ কোটি ৫ লাখ, ২০১৫-১৬ সালে ৬৫৬ কোটি ৩০ লাখ, ২০১৬-১৭ সালে ৪৮০ কোটি ৯৪ লাখ এবং ২০১৭-১৮ সালে ৪৮৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে বিজেএমসি ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লাভ করেছে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন