প্রাকৃতিক গ্যাসের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হলে এলপিজির চাহিদা বাড়বে

দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) চাহিদা বাড়ছে। চাহিদার জোগান দিতে খাতটিতে নতুন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন উদ্যোক্তারা। দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন এলপিজিতে বিনিয়োগ করেছে, জি-গ্যাস নামে এরই মধ্যে যা পরিচিত হয়ে উঠেছে। নিজেদের বিনিয়োগ ও এলপিজির আগামী দিনের চাহিদাসহ আরো বিভিন্ন বিষয় বণিক বার্তার কাছে এক সাক্ষাত্কারে তুলে ধরেছেন জি-গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) আবু সাইদ রাজা। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সুমন আফসার

দেশে এলপিজির চাহিদা বাড়ছে। আগামীতে কী হারে চাহিদা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন?

গত কয়েক বছরে এলপিজির চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এখন বাংলাদেশে এলপিজির মোট চাহিদা হলো সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ টন, আগে যা ছিল চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। আগামী দুই বছরের মধ্যে এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ এলপিজির চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে ধারণা করছি আমরা। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে এটি যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তাতে এলপিজির প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হবে না। এর কারণ হলো দেশে এই মুহূর্তে নতুন সংযোগ বন্ধ। তবে রাজনৈতিক কারণে কোথাও কোথাও হয়তো সংযোগ দেয়া হচ্ছে, উদাহরণ হিসেবে রাজশাহীর কথা বলা যেতে পারে। ঢাকাসহ সারা দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের যতগুলো অবৈধ সংযোগ রয়েছে, তা বিচ্ছিন্ন করা হলে এলপিজির চাহিদা ১০-১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে।

এলপিজিতে কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ হচ্ছে। এ খাতে গ্রাহক মূলত কারা?

এলপিজির ফোকাসড মার্কেট মূলত তিনটি। একটি হলো গৃহস্থালি, যেটি আমরা বাসাবাড়িতে ব্যবহার করছি। আরেকটি হলো বাণিজ্যিক। এছাড়া শিল্পেও ব্যবহার হয় এলপিজি।

কোন ধরনের গ্রাহককে লক্ষ্য করে বিপণনে গুরুত্ব দিচ্ছেন?

আমাদের লক্ষ্য কিছুটা ভিন্ন। এখন যানবাহনে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) ব্যবহার কমে আসছে। এর পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে অটোগ্যাস। ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে অটোগ্যাসের বাজার। প্রাকৃতিক গ্যাস থাকুক বা না থাকুক, মানুষ অটোগ্যাসকে নিরাপদ মনে করছে। গাড়ির জ্বালানির বড় একটা বাজার রয়েছে দেশে। এ বাজার দখল করতে যাচ্ছে অটোগ্যাস। শিল্পের ক্ষেত্রেও এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে।

গৃহস্থালিতেও প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ না পেলে এলপিজির ওপর ভরসা করতে হয়। নগরায়ণের কারণে এখন অধিকাংশই বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে। আগে ভবনগুলো দুই-তিন অথবা ছয়তলা হতো। সেগুলোয় যতটা সহজে এলপিজির সিলিন্ডার
ব্যবহার সম্ভব ছিল, এখনকার বহুতল ভবনে তা অনেকটাই ঝক্কির। তবে এর জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সিলিন্ডার ব্যাংক তৈরি হয়েছে।

কতগুলো ভবনে সিলিন্ডার ব্যাংকের এ ব্যবস্থা তৈরি করেছেন আপনারা?

এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় আবাসন প্রকল্পে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এটি একটি আধুনিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা। অর্ধশতাধিক ভবনে এমন ব্যবস্থা চালু করেছি আমরা।

এক্ষেত্রে কী পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়?

ভবনে এলপিজির সিলিন্ডার ব্যাংক ব্যবস্থা তৈরিতে ব্যয় দুভাবে হতে পারে। নির্মাণের সময়ই প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগের জন্য ভবনে স্থায়ীভাবে পাইপলাইন রাখা হয়। আমরা এর সঙ্গে সিলিন্ডার সংযোগের জন্য বাকি ব্যবস্থাটুকু করে দিচ্ছি। এছাড়া ভবন মালিক চাইলে নিজেও এটা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আমরা শুধু সিলিন্ডার সরবরাহ করি। অর্থাৎ এ ব্যবস্থাটির জন্য ভবন মালিকের আলাদাভাবে তেমন কোনো বিনিয়োগ করতে হয় না।

এলপিজি সিলিন্ডারের মান সম্পর্কে বলুন।

আমদানি করা সিলিন্ডারের চেয়ে আমাদের সিলিন্ডার অনেক বেশি মানসম্মত। আমাদের শিটগুলো জাপান থেকে আসে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের নির্ধারিত নিয়ম মেনে সিলিন্ডারগুলো তৈরি হয়। সব ধরনের পরীক্ষার পর এগুলো বাজারে আসে। সিলিন্ডার নষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাধারণত একটা সিলিন্ডারের লাইফটাইম ২০-২৫ বছর। তবে প্রতি পাঁচ বছর পর পর সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে হবে।

নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে মানুষের মধ্যে। এ সম্পর্কে জানতে চাই।

এলপিজি সিলিন্ডারের নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা চালু রয়েছে। অনেকেই এটিকে বোমা বলে মনে করেন। অথচ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে নিরাপদ জ্বালানি ব্যবস্থা এটি। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতেও দেখা গেছে, দুর্ঘটনার জন্য এলপিজি সিলিন্ডার দায়ী নয়। এলপিজি সিলিন্ডার আগুনে ফেলে দিলেও বিস্ফোরণ ঘটবে না। কারণ হলো, প্রত্যেকটি সিলিন্ডারে সেফটি রিলিফ ভালভ রয়েছে। প্রচণ্ড উত্তাপে এ ভালভ খুলে যায়। ফলে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সুযোগ থাকে না।

গাড়িতে এলপিজি ব্যবহার কতখানি নিরাপদ?

অটোগ্যাসের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তার বিষয়টি একই রকম। অটোগ্যাস শুধু নিরাপদই নয়, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অটোগ্যাসের সিলিন্ডার সিএনজির সিলিন্ডারের তুলনায় হালকা, অনেক বেশি আধুনিক। গাড়ির জন্য এটি নিরাপদ।

অটো গ্যাস স্টেশনগুলোর অবস্থান দেশের কোন অঞ্চলে বেশি?

মূলত খুলনা অঞ্চলেই অটোগ্যাস স্টেশন বেশি। এর মূল কারণ হলো, ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজি ব্যবহার শুরু হলেও সে সময় দেশের অন্য এলাকাগুলোয় অকটেনের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল। সিএনজির প্রাপ্যতা না থাকায় ওইসব এলাকায় বিকল্প হিসেবে অটোগ্যাসের চাহিদা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সিএনজি থাকায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে অটোগ্যাসের প্রচলন সেভাবে বাড়েনি।

আপনারা কতগুলো স্টেশনে এলপিজি সরবরাহ করছেন?

বর্তমানে সারা দেশে ১১টি ফুয়েল স্টেশনে এলপিজি সরবরাহ করছি। চলতি অর্থবছর প্রায় ৫০টি স্টেশন যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এলপিজির আমদানি সম্পর্কে জানতে চাই।

দেশের এলপিজির চাহিদার ৬-৭ শতাংশ উৎপাদিত হয়। এটি মূলত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের পরিশোধনের সময় উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। দেশে উৎপাদিত এলপিজির পুরোটাই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। আর চাহিদার বাকি অংশটি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো এলপিজির অন্যতম উৎস।

এলপিজি খাতে চাহিদা ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য রয়েছে কি?

বর্তমানে এ খাতে ১৬-১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকার অনুমোদন দিয়েছে ৫৬টির মতো প্রতিষ্ঠানকে। এ বছরই তিন থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আসতে পারে। চাহিদার তুলনায় এলপিজি খাতের সক্ষমতা অনেক আগেই বেশি হয়ে গেছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের বাজারের জন্য ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানই যথেষ্ট।

এখন জি-গ্যাসের মার্কেট শেয়ার কতটুকু?

আমরা ২০১৭ সালের অক্টোবরে উৎপাদন শুরু করেছি। এ মুহূর্তে আমাদের মার্কেট শেয়ার ৯ শতাংশের মতো। সারা দেশে আমাদের পরিবেশক রয়েছে। স্টোরেজ ক্যাপাসিটি তিন হাজার টন। খুলনায় আরো ১ হাজার ৮০০ টন সক্ষমতার স্টোরেজ করা হচ্ছে। এর পর রূপগঞ্জে ১ হাজার ২০০ টন সক্ষমতার আরেকটি প্লান্ট করছি আমরা। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় আরো স্টোরেজ সুবিধাসম্পন্ন স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

এসব স্টেশন এলপিজি পরিবহনের ব্যয় বাড়াবে নাকি কমাবে?

এলপিজির জন্য বড় সমস্যা হলো পরিবহন ব্যয়। স্টেশন সুবিধা তৈরি হলে ব্যয় কিছুটা কমবে। পরিবহন ব্যয় কমিয়ে আনা ও সরবরাহ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এ ধরনের স্টেশন অত্যন্ত কার্যকর। এলপিজি সিলিন্ডারের পরিবহন ব্যয়টা গড় হিসাবে ধরে একই দরে বিক্রি করতে হয়। সবাই এভাবে বিক্রি করছে। আমরাও তাই করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন