বৈষম্য মোকাবেলা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত

মাহমুদ মোহিলদিন কারোলিনা সানচেজ-পারামো

অতিদারিদ্র্য নিরসনে বিশ্বব্যাপী গৃহীত পদক্ষেপগুলো সন্তোষজনক হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এক্ষেত্রে অগ্রগতিতে এক ধরনের ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়। সমস্যাটি পরিষ্কার। অতিদারিদ্র্য দূরীকরণে তাই প্রয়োজন বৈষম্যের মোকাবেলা করা।

সুখবরটি হচ্ছে, ১৯৯০ সাল থেকে দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী সব মানুষের মধ্যেও বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। তবে দুঃসংবাদটি হচ্ছে, রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্য বেড়েছে। ২৫ বছর আগের তুলনায় আজ একজন সাধারণ ব্যক্তি অনেক বেশি উচ্চ অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করছে। আয় ও সম্পদের বাইরেও দেশের মধ্যে এখনো বড় ধরনের অসমতা বিদ্যমান। যেমন খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ভূমি, সুপেয় পানি এবং পরিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিমিত্তে অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়।

যদিও এটি অনিবার্য কোনো পরিণতি নয়, বরং বৈষম্য একটি রাজনৈতিক পছন্দ বা সিদ্ধান্ত। যেসব সরকার আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে তার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের পাশাপাশি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে চায়, তারা এরই মধ্যে উভয় ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা নিয়েছে এবং খানিকটা অগ্রগতি সাধনেও সক্ষম হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, বিশেষ করে ১০ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা—বৈষম্য হ্রাস করা, যেখানে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব মনোযোগ দেয়া হয়েছে।

চলতি মাসে জাতিসংঘের হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরামের (এইচএলপিএফ) বৈঠকে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জানার সুযোগ হয়েছে জাতীয় পর্যায় ও আন্তর্জাতিকভাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সার্বিক অগ্রগতি সম্পর্কে। এদিকে বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ একটি প্রস্তুতিমূলক সভার আয়োজন করে। সেখানে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন দেশের সরকার কীভাবে ওই ক্ষেত্রগুলোয় তাদের প্রচেষ্টার পরিধি বৃদ্ধি করতে পারে। সভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে:

্ব বৈষম্য সচরাচর একটি সামাজিক পরিস্থিতি দ্বারা পরিচালিত ও গঠিত, যেমন একটি পরিবারের গঠন বা আর্থিক অবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান, জাতিগত পরিচয় ও লিঙ্গ। উল্লিখিত প্রতিটি উপাদানই সুযোগের বৈষম্য সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে এবং কারণগুলো স্বয়ং আয়বৈষম্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়। কারণ সুযোগের বৈষম্য এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের সামাজিক গতিশীলতা হ্রাস করে এক ধরনের ধারাবাহিক বৈষম্য ফাঁদ সৃষ্টি করে।

্ব সুযোগের বাধা দূর করার জন্য সরকারকে অবশ্যই বৈষম্যমূলক আইন শনাক্তকরণ এবং তা নির্মূল করে বৈষম্যের মূল কারণগুলোর সমাধান করতে হবে। অন্তত যেগুলো বৈষম্য সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া বৈষম্যের শুরুটা হয় শৈশব থেকে, তাই সরকারগুলোকে উচ্চমানের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও শৈশবকালের প্রাথমিক শিক্ষায় অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু অল্প বয়স থেকে মানবিক মূলধন সৃষ্টি সমর্থন করেই আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে এক প্রজন্মের বৈষম্য অন্য প্রজন্মে ছড়াবে না।

্ব এজন্য বিনিয়োগের জন্য অতিরিক্ত অভ্যন্তরীণ সম্পদের প্রয়োজন হবে। সাধারণত সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতিরিক্ত করারোপের বিষয়টি সমালোচনামূলক। সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রসারিত করতে হবে, যার মাধ্যমে সরকার কর ফাঁকি প্রতিরোধ করতে পারে এবং সীমান্তজুড়ে সম্পদের অবৈধ প্রবাহ সীমিত করতে পারে। আয় ও সম্পদবৈষম্য রুখতে সম্পদের সমন্বিত ব্যবহারের লক্ষ্যে সামাজিক রূপান্তর ও সুরক্ষা শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে।

্ব সরকারগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে যে সমাজে যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রয়েছে, তারাই প্রগতিশীল নীতির সুবিধাগুলো ভোগ করবে। এদিকে বৈষম্য ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সময় নীতিনির্ধারকরা অবশ্যই তার অবহেলিত নাগরিকদের মতামত নেবেন এবং তাদের অবস্থান থেকে বোঝার চেষ্টা করবেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুযোগ প্রদান বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোয় আরো বেশি বিশুদ্ধ বিশ্লেষণ জোগাবে, বিশেষ করে এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে কোন জায়গায় সম্পদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেখানে সরাসরি সম্পদ পৌঁছানো সম্ভব হবে।

্ব তবে শেষমেশ কার্যকর নীতি-নকশার ক্ষেত্রে তথ্যগত সীমাবদ্ধতা একটি প্রতিবন্ধক। বৈষম্যকে বিশদভাবে বর্ণনা করতে যেকোনো গৃহীত নীতি, আইন, রাজনৈতিক কাঠামো কিংবা সাংস্কৃতিক আদর্শের মাধ্যমে কারা সুবিধা ভোগ করবে, নীতিনির্ধারকরা অবশ্যই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবেন। শিক্ষা, জলবায়ু, স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা ও অবকাঠামো অনেক ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম, যেখানে সরকারের অনেক বেশি সঠিক তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন পড়ে। যদিও তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি ব্যয়বহুল। তবে দক্ষতা, নিবিড় চর্চা ও সাম্প্রতিক উদ্ভাবনগুলো ব্যাপকভাবে সরকারের বিকল্প গ্রহণের সুযোগ বিস্তৃত করেছে।

্ব উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত তথ্য উত্সগুলো যেমন গৃহস্থালিসংক্রান্ত জরিপ, যা সাধারণত শীর্ষ আয় (শীর্ষস্থানীয় ১ শতাংশসহ) গণনা করতে ব্যর্থ হয়, শূন্যস্থানটি এখন প্রশাসনিক ও করবিষয়ক তথ্যের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। তবু এক্ষেত্রে আমাদের আরো উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সরকার, অংশগ্রহণকারী, বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজের সংগঠন এবং অন্য মাধ্যমগুলোর সরাসরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১০ নম্বর লক্ষ্যের—‘বৈষম্য হ্রাস: দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্য হ্রাস করা’—অগ্রগতি পরিমাপ করা সম্ভব হয়।

প্রায়ই বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দেয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে যে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য কেবল দেশের অর্থনীতির জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর। সমসুযোগ ও নীতির অনুপস্থিতিতে সামাজিক সংহতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনগণের আস্থা টেকসই হয় না।

সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় এসডিজি সম্মেলন উপলক্ষে বিশ্বনেতাদের তাই একগুচ্ছ অগ্রগতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিজেদের অঙ্গীকারগুলো তাই তাদের পুনর্নিশ্চিত করা প্রয়োজন, বিশেষ করে এসডিজির ১০ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপকে তাই বর্তমান এবং ২০৩০-এর মধ্যকার প্রচেষ্টার জন্য শক্তি ও সম্পদের দিকে মনোযোগী হতে হবে। তবে এটা যথেষ্ট নয়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বৈষম্য নিরসনে একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ গড়ে তুলতে হবে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

মাহমুদ মোহিলদিন: ২০৩০ উন্নয়ন এজেন্ডা, জাতিসংঘ সম্পর্ক ও অংশীদারিত্ববিষয়ক বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট

কারোলিনা সানচেজ-পারামো: বিশ্বব্যাংকের পভার্টি ও ইকুইটি গ্লোবাল প্র্যাকটিসের বৈশ্বিক পরিচালক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন