গুজব, ধর্ষণ, গণপিটুনি : দায়ভার অনেকের

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

সমাজের একশ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত মেধাবী, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত ও দায়িত্বশীল। অন্যদিকে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধও, যা এক ধরনের অন্ধকার এবং পশ্চাদমুখী সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে। দেশের সাম্প্রতিক কিছু দুর্ঘটনায় এ রকম মনে হয়।

পত্রপত্রিকার ও ইলেকট্রনিক নানা মাধ্যমে বিষয়গুলো পাঠক, দর্শক এবং অন্য সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর নাগরিকদেরও বিচলিত করছে। সেই সবগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। দু-একটি বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করছি।

কিছুদিন থেকে শোনা যাচ্ছে যে দেশে গলাকাটা মরদেহের সংখ্যা এবার একটা গুজবকে নিয়ে বাড়ছে। যে কারণে দেশের একজন জনপ্রিয় এবং একুশে পদক বিজয়ী কবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুকে) বক্তব্য দিতে গিয়ে লিখেছেন, “এই পদ্মা সেতু তো দেখি দেশটাকে একটা পাগলাগারদ বানিয়ে ছাড়বে। পদ্মা সেতু নির্মাণে অনভিপ্রেত বিলম্বের কারণে স্বার্থান্বেষী মহল প্রচারিত ‘মাথা চাই’ গুজবটি ডালপালা মেলার সুযোগ পেয়ে এখন বাংলাদেশের মানুষের রাতের নিদ্রা হারাম করে দিতে বসেছে। রাতের নিদ্রাই বলি কেন শুধু, দিনে-দুপুরে শত শত মানুষের চোখের সামনে সন্দেহের বশে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে যাওয়া মাকে। এ আমরা কোথায় চলেছি?” কবির সঙ্গে একমত। সমস্যার গভীরেও যাওয়া দরকার। সমাজে অনেক ঘটনা আমাদের নাড়া দেয়। তার পরও সেই ঘটনাগুলো অব্যাহতভাবেই বিরাজ করে। এর একটি কারণ, সমাজে এখন আমাদের কাছে ক্রমান্বয়ে সবই স্বাভাবিক, সহজ ও গ্রহণীয় হয়ে যাচ্ছে। কবি প্রশ্ন করেছেন, ‘এ আমরা কোথায় চলেছি!’ একটু যোগ করে বলি, কোথাও কি আমরা যে পথে চলার কথা, যে কথা বলার, যা হওয়ার সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি? এ সময় বা কালে এসে কেনইবা আমরা কেউ গুজবে ভর করব বা সেটাতে বিশ্বাস করব! গুজবের যুগ অথবা হীরক রাজার দেশের শাসনামল, ব্যবস্থা এবং চেষ্টা কি অতিক্রম করে আসিনি? যদি এসে থাকি তাহলে কেনইবা এসব উঠবে, দাঁড়াবে এবং নিরপরাধ মানুষ খুন, হত্যা বা ধর্ষিত হবে। কোনো কাজে, সেটা সেতু নির্মাণ হোক বা কোনো দালান, তার নির্মাণে কোনো বিলম্বে এ সময় কে বা কারা নরবলির প্রয়োজন বলে ছড়াবে এবং সেই কথা শুনে আমরা বস্তাভর্তি মানুষের মাথা ও রক্তবিষয়ক গুজবে বিশ্বাস করছি? এ প্রচারণাইবা কে ও কেন করছে? আর সেটাওবা কে এবং কারা শুনছি? কেনইবা শুনছি? আবার এ কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ কেন হবে? এগুলো সবই বাড়াবাড়ি। সমাজে এখন সব ক্ষেত্রেই ‘বাড়াবাড়ি’র কৃষ্টি ও ঝোঁক বাড়ছে। আমরা রাজনীতিতে বাড়াবাড়ি করছি। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। অধিকার ও প্রাপ্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। সম্পর্ক নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। ইতিহাসের সত্য-মিথ্যা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। সম্পদ এবং এর বণ্টন নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। সহনশীলতার প্রশ্নে বাড়াবাড়ি করছি। বিচার, আইন-শৃঙ্খলা এবং মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। এ কৃষ্টি নির্দিষ্ট একটি বা দুটি দেশেই নয় শুধু; বহু দেশ, সমাজ, গোষ্ঠী ও মানুষের সব শ্রেণী, অবকাঠামোয় এখন তা বিরাজমান বলা যায়। একেক সমাজে ও রাষ্ট্রে এর বিভিন্ন পরিচয় বা নাম। কোথাও গুজব, কোথাও রিউমার, কোথাওবা কুসংস্কার, কোথাও অলটারনেটিভ ট্রুথ। সংক্ষেপে এসব সভ্যতা, আধুনিকতা, জ্ঞান, সুশাসন ও সুরাজনীতি এবং মানবতার শত্রু। এসব মোকাবেলায় কোনো সামাজিক গোষ্ঠী বা কোনো দল একা অগ্রসর হতে পারবে না। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় নীতিকেও এক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো অন্যায়ের বিচার ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতে যেন না পড়ে। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে আরো অধিক সচেতন, সজাগ ও কার্যকরী ভূমিকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারলে গুজব বা অসত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন। আমাদের ছোটবেলায় শুনতাম দেশে ছেলে ধরার গল্প। তখন কোথাও কোথাও এর সত্যতাও ছিল। এখনো সেটা থাকতেই পারে। আজ থেকে বছর কয়েক আগের কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ব্যক্তি তিন-তিনটি কিশোরী মেয়েকে ধরে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল বহু বছর। পরে ধরা পড়ে যায়, বিচার হয়। জেল হয়। মেয়েগুলো মুক্ত হয়। আমাদের সমাজে কতটা খুন, গুম, হত্যা বা ধর্ষণের বিচার করতে পারছি! অন্যায়ের বিচারই হয় না আজকাল। গুম হচ্ছে এবং হয়েছেও অনেক নাগরিক। ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত উপায়ে হত্যা বা খুনও হয়েছে অনেক। এসবের কয়টার বিচার আমরা সুনিশ্চিত করতে পেরেছি, দায়ীদের শাস্তি দিতে পেরেছি? সমাজে এবং রাষ্ট্রে হত্যা, খুন, গুম ও গুজব প্রচার করে একশ্রেণীর মানুষ দিব্যি ভালো আছে। কোনো ক্ষতিই হচ্ছে না। আমরা তাদের শনাক্ত করে বিচার করেছি কি এখনো? দেশ এখন পাগলাগারদ। এটা নতুন নয়, শহরে, গ্রামে, মহল্লায় নানা ধরনের মাস্তানের ছোবল- আক্রোশ এবং অনাচার-অত্যাচার থেকে কি এখনো দেশের সাধারণ নাগরিকদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছি? বাজারে গেলে বিক্রেতার কাছ থেকে সবাই কি ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি? আবার সব ক্রেতাও কি পণ্যের ন্যায্যমূল্য দিচ্ছি? উত্পাদক কি পাচ্ছে তার উত্পাদনের ন্যায্যমূল্য? নাগরিকদের সবাই কি পাচ্ছে বৈষম্যমুক্ত সমাজ, অবকাঠামো ও শাসন, যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল? এ সবকিছুর উত্তরের মধ্যেই আছে সেই প্রশ্নের উত্তর যে আমরা কোথায় যাচ্ছি—ওই পথের ঠিকানা। গণপিটুনির দায়ে অনেক দরিদ্র, গরিব, অসহায় ব্যক্তি বা মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার অসভ্য সংস্কৃতি আমাদের মতো গণতান্ত্রিক এবং আর্থিক দুর্বল সমাজে ছিল, যা এখনো আছে।

গণপিটুনিটা পাক-ভারত উপমহাদেশেই বেশি ঘটে। এখানে গণআদালত হয়। আবার কারো মুখ চাঁদে দেখা গেছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে। এর অনেক কারণের অন্যতম আমাদের অতি আবেগ, অতি উচ্ছ্বাস, অনিশ্চিত বেকারত্ব। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং অপকৃষ্টিটাও এর সঙ্গে যুক্ত। আমরা অপরাধের শাস্তি বা বিচারে যতটা তত্পর, সেই তুলনায় অপরাধের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানের বিষয়ে পশ্চাদমুখী, রক্ষণশীল। যেকোনো অপরাধের পেছনে কেবল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতা এবং শক্তিই যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রভাবকে ব্যবহার করারও সম্পর্ক আছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিশেষ করে কোনো দুর্ঘটনার বিচ্ছিন্ন কারণ নেই। তাই বিচ্ছিন্ন সমাধান দেয়া বা বলাও যায় না।

সমাজে, অসহিষ্ণুতা, অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বৈষম্য এবং অনিরাপত্তা বাড়ছে। সেখানে নানা গুজব, অবিচার, অন্যায়, গণপিটুনি এবং স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। উদ্ভূত বিষয়গুলো সমাধানে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের সার্বিক চৈতন্যে সমাজের অপরাধ, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরো জোরালো হোক—এটিই কামনা করি।

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন