চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে কাজ হারানোর ঝুঁকি

অভিঘাত মোকাবেলায় প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি জরুরি

অতীতের তিনটি শিল্প বিপ্লব পাল্টে দিয়েছে মানবেতিহাসের গতিপথ। বিশ্বজুড়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রক্রিয়া বেগবান। ধারণা করা হচ্ছে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, বিদ্যুত্ কিংবা ইন্টারনেট আবিষ্কার—এ তিন শিল্প বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ডিজিটাল বিপ্লব। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নিতে উত্পাদন প্রক্রিয়ায় যেমন উন্নত প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটাতে হবে, তেমনি উত্পাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত দেশের শ্রমিক-কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে জোর দিতে হবে। কেননা সার্বিক প্রস্তুতি ব্যতীত শ্রম খাতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা সম্ভব হবে না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় বক্তাদের দেয়া তথ্য অনুসারে, আগামী ২০ বছরে দেশে শ্রম খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং মোট ৫৫ লাখ কর্মসংস্থান ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। তাই বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কর্মপন্থা গ্রহণ জরুরি।

আমরা জানি, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অশিক্ষিত ও অদক্ষ শ্রমিক শ্রেণী। তথ্য বলছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে তৈরি পোশাক শিল্পে ৩০ শতাংশ, ফার্নিচার শিল্পে ৬০, চামড়া খাতে ৩৫ ও ট্যুরিজম খাতের ২০ শতাংশসহ মোট ৫৫ লাখ কর্মসংস্থান ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অল্পশিক্ষিত নারী শ্রমিক। পরিস্থিতি সামলাতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করা চাই। তাছাড়া পণ্য উত্পাদন থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে বলে জনশক্তির ব্যবহার হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির বিষয়টি জরুরি। প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বৃদ্ধির দিকটিও প্রাসঙ্গিক। আসন্ন সমস্যা মোকাবেলায় এরই মধ্যে ইউরোপে কারখানার শ্রমিকদের সেবা খাতভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের নীতিনির্ধারকরাও নিজেদের শ্রমিক-কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে কার্যক্রম গ্রহণ করছেন। কেননা দক্ষ শ্রমিক-কর্মী ছাড়া শিল্প-কারখানায় উত্পাদনশীলতা কমে যাবে এবং পণ্যের মান উন্নত হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে অটোমেশন ও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে পোশাক শিল্প রফতানি বাজার হারাতে থাকবে এবং প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া বৈশ্বিক অটোমেশনের মূলধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা যদি আমাদের শিল্প-কারখানা অটোমেশন না করি, সেক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকব। তাই আমাদের নীতিনির্ধারকদের কর্মপন্থা তৈরির পাশাপাশি শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়নের ব্যত্যয় নেই।

আশির দশকে সহজে চাকরি পাওয়ার আশায় অধিকাংশ মানুষ টাইপিং শিখলেও নব্বইয়ের দশকে কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে ওই মানুষগুলোই কাজ হারায়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে পোশাক ও বস্ত্র খাতের উত্পাদন প্রক্রিয়ায় ক্রমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, বিগ ডাটা, অটোমেশন, ভ্যালু চেইনের ডিজিটাইজেশন, মাইক্রো ফ্যাব্রিকস, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের ব্যবহার বাড়বে। বিশ্বের অন্যতম পোশাক রফতানিকারক দেশ বাংলাদেশকে তাই এখন থেকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কারখানার ডিজিটালাইজেশনেও পিছিয়ে থাকা চলবে না। যদিও পোশাক তৈরিতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছি। কিন্তু পণ্যের মান ও সক্ষমতা বাড়াতে কারখানায় আরো স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ও দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করা চাই। তা না হলে বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের প্রভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তাই প্রস্তুতি গ্রহণে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। বিশেষ করে রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে প্রযুক্তিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক সংকট দূর করতে হবে। বর্তমানে পাঁচ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানায় ৪০-৪৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত, যাদের বেশির ভাগই অদক্ষ। পোশাক শিল্পের সাতটি গ্রেডের চারটিতেই কাজ করছেন আধা ও অদক্ষ শ্রমিক। বিআইডিএসের তথ্যানুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ শিল্পে শ্রমিকের চাহিদা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তাই বাংলাদেশকে নতুন করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরির চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। দক্ষ শ্রমিক-কর্মী তৈরির লক্ষ্যে গবেষণা সংস্থা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা জরুরি। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সংযোগ ঘটাতে হবে। পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় সমর্থন প্রদানের জন্য উভয় পক্ষ থেকে বিশেষ তহবিলের জোগান দিতে হবে। প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে দক্ষ প্রশিক্ষক এনে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি   প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

কেনিয়ার ডিজিটাল বিপ্লব সেখানকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে সরকারি বন্ড মার্কেটসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। চীনের প্রযুক্তি প্লাটফর্মগুলো উল্লেখযোগ্য হারে ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট হ্রাসে সহযোগিতা করছে। পরিবর্তিত সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যের ধরনের কারণে বিশ্বব্যাপী ‘গিগ ইকোনমি’র প্রসার ঘটছে। পরিবর্তনের এ ধারা আমরা যত দ্রুত আয়ত্ত করতে পারব, তত এগিয়ে থাকব। পাশাপাশি কোন ক্ষেত্রগুলোয় নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে, সে বিষয়ে আমাদের নিজেদের গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগেই গত দুই দশকে ইউরোপ ও আমেরিকায় শিল্প-কারখানায় ১০ শতাংশ কর্মচ্যুতি ঘটেছে। তবে অন্য ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে। এ কারণে বেকারত্বের হার কমেছে। অন্যান্য দেশের মতো আমরাও যদি জনশক্তির উন্নয়নে মনোযোগী হই, তাহলে কর্মসংস্থানগত ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে। দেশে প্রচুর অদক্ষ ও আধা দক্ষ মানবসম্পদ থাকলেও দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। তবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও অটোমেশন প্রযুক্তি আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, যদি আমরা মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে পারি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন