ট্রেজারি বন্ডে কর-পরবর্তী আয় ৯ শতাংশের বেশি

বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান আরো চাপে পড়তে পারে

হাছান আদনান

ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয় সরকার। বছরখানেক আগেও ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে কর-পরবর্তী আয়ের (ইল্ড) হার ছিল অনেক কম। এজন্য বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে পারলেই বেশি খুশি হতো ব্যাংকগুলো। বর্তমানে সে পরিস্থিতিতে বদল এসেছে। জুলাই শেষে ট্রেজারি বন্ড থেকে কর-পরবর্তী আয় প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশে ঠেকেছে। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না করে বরং সরকারকে ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহী ব্যাংকগুলো। এতে বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের জোগান আরো চাপে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংকিং খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ নেয়ার জন্য ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে সরকার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে ব্যবহার করে ট্রেজারি বিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে সব মেয়াদের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের কর-পরবর্তী আয় বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই শেষে ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের কর-পরবর্তী আয় (ভারিত গড়) ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশে ঠেকেছে। ১৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ক্ষেত্রে এ হার ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। যদিও ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ১৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের কর-পরবর্তী গড় আয় ছিল ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অন্যান্য মেয়াদের বিল-বন্ডের কর-পরবর্তী আয়ের হারও অনেক বেড়েছে।

যেকোনো দেশেই সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হলো সরকারকে ঋণ দেয়া। ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দেয় বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার মাধ্যমে। আর জনগণ সরকারকে ঋণ দেয় সঞ্চয়পত্র কিনে। আগে উচ্চ সুদহার ছিল সঞ্চয়পত্রে। এবার যুক্ত হয়েছে ট্রেজারি বন্ডেও। সরকার সাড়ে ৯ শতাংশ ইল্ডে ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিলেও বেসরকারি খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলছে। এ নীতিকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সাপ্লাই লাইন ঠিক না করে সরকার ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলছে। অথচ নিজেই ৯ শতাংশের বেশি সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর জন্য সরকারি বিল-বন্ড কেনাই তো ভালো। ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান সংকটের সমাধান ঋণ ও আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দিয়ে হবে না। খেলাপি ঋণ আদায়ের সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করতে হবে। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ সংকট কাটবে না। বেশি চাপ দিলে শ্যাডো ব্যাংকিং শুরু হবে। এটি সংকটকে আরো গভীর করবে।

ব্যাংকিং খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়ার জন্য ট্রেজারি বিল ইস্যু করে সরকার। ৭, ১৪, ৩০, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ইস্যু করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ইস্যু করা হয় ট্রেজারি বন্ড। ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ড বিক্রি করে ঋণ নেয় সরকার। সরকারের পক্ষে এ কাজটি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দরপত্র আহ্বান করে বিল ও বন্ডগুলো বিক্রি করা হয়। যদিও শুধু বাজারদরের ওপর ছেড়ে না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিল ও বন্ডের জন্য একটি দর নির্ধারণ করে দেয়। চাহিদার চেয়ে তারল্যের জোগান বেশি হলে সেটি বেঁধে দেয়া দরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যথায় এ দর আরো বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই শেষে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের কর-পরবর্তী গড় ছিল ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। যদিও এক বছর আগে একই মাসে এ হার ২ দশমিক ৫৪ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের কর-পরবর্তী আয় ৭ দশমিক ১৮ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশে ঠেকেছে। অথচ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এ হার ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭৫ ও ৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের কর-পরবর্তী আয় ছিল গড়ে ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের জুলাইয়ে এ হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। একইভাবে পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের কর-পরবর্তী আয় ৮ দশমিক ৩১, ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ৮ দশমিক ৮৩ এবং ১৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ক্ষেত্রে কর-পরবর্তী আয় ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। আর ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ক্ষেত্রে তা ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশে।

ট্রেজারি বন্ডে কর-পরবর্তী উচ্চ আয় রেখেই সব ব্যাংককে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বিষয়টিকে যৌক্তিক বলে মনে করছেন না ব্যাংকাররা। বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরিস্থিতি যা, তাতে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করাই বেশি লাভজনক। সরকার আমাদের বলছে ৯ শতাংশ সুদে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে। যেখানে ঋণের ঝুঁকি শতভাগ। অথচ সরকার সাড়ে ৯ শতাংশ ইল্ডে ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে ঋণ নিচ্ছে। যেখানে বিনিয়োগ প্রায় শতভাগই নিরাপদ। পরিস্থিতি যা, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়ার চিন্তা বাদ দেয়াই ভালো।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা এমনিতেই পূরণ হচ্ছে না। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। বিপরীতে মাত্র ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি কমলেও সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে।

ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিদ্যমান সুদহার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকে আরো নিরুৎসাহিত করবে বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান। তিনি বলেন, সরকার সঞ্চয়পত্র ও ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রি করে ঋণ নিচ্ছে। এ দুটি উপকরণের সুদহারই প্রায় ডাবল ডিজিটের। ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেক দিন থেকেই শ্লথ। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী। সরকার বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। ট্রেজারি বন্ডের কর-পরবর্তী উচ্চহার বেসরকারি বিনিয়োগকে অবশ্যই নিরুৎসাহিত করবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন