বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিতে কর রেয়াত সুবিধা দিয়ে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পণ্য আমদানি করে রেয়াত সুবিধা নিচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে রেয়াত সুবিধায় পণ্য আমদানি করে বাইরে বিক্রিরও অভিযোগ আছে। এর মধ্য দিয়ে রেয়াত সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করছে রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটি।
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সব ধরনের কর অবকাশ সুবিধা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও রেয়াতযোগ্য পণ্যের সুনির্দিষ্ট তালিকা করা হয়নি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জারি করা এনবিআরের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে শুধু বলা হয়েছে, কোনো পণ্য চালান খালাসকালে রাজস্বহানির সম্ভাবনা থাকলে সেসব পণ্যের চালান খালাস করে এনবিআরের নজরে আনতে হবে। এ অস্পষ্টতার সুযোগে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তারা অরেয়াতযোগ্য পণ্য আমদানি করছেন।
রেয়াত সুবিধার অপব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় গত ২৫ জুলাই এনবিআরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। সেখানে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বিদ্যুৎ খাতে অরেয়াতযোগ্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং, বোল্ডার পাথর, এমএস রড, হট রোল্ড স্টিল প্লেট, স্টিল স্ট্রাকচার, স্টিল পাইপ, অ্যাংকর বোট ও ড্রেজার। রেয়াতযোগ্য পণ্যের সুনির্দিষ্ট তালিকা না থাকায় এসব পণ্য খালাসও হচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে নদী খননকাজের জন্য ড্রেজার ও অ্যাংকর বোট আমদানি হয়েছে। রেয়াত সুবিধার বাইরে থাকা এ পণ্য আমদানি নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন পায়রা কাস্টম হাউজের কমিশনার। তথ্য গোপন করে বিদ্যুৎ খাতের আড়ালে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব পণ্য আমদানি হয়ে থাকতে পারে বলে সভায় মত দেন তিনি।
রেয়াত সুবিধায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি রোটর, জেনারেটর, ট্রান্সমিশন লাইনের পাশাপাশি বোল্ডার পাথর, কেবল, পেইন্ট, ট্রান্সফরমার অয়েল, লুব ব্লেন্ডিং অয়েলের মতো পণ্য আমদানিরও চেষ্টা হচ্ছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে পণ্য তালিকা সুনির্দিষ্ট না থাকায় এ জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে সভায় জানান বেনাপোল কাস্টম হাউজের কমিশনার।
এনবিআরের তথ্যমতে, মোংলা বন্দর দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে পাথর, রড, স্টিল শিটের মতো পণ্য আমদানির ঘটনা ঘটছে। এসব পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন থাকায় এতে রেয়াত সুবিধা দিলে তা স্থানীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
পণ্যের তালিকা নির্দিষ্ট না থাকায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকেও। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের রেয়াতযোগ্য পণ্যের সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করতে এনবিআরে প্রস্তাব দিয়েছে তারা। কাস্টম হাউজের কমিশনার মো. ফখরুল আলম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রজ্ঞাপনে অস্পষ্টতার কারণেই এমনটা হচ্ছে। এ অস্পষ্টতা দূর হলে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া আরো সহজ ও গতিশীল হবে। আমাদের প্রস্তাবে বলেছি, প্রজ্ঞাপনে রেয়াত সুবিধা দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রকে, ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে নয়।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সব ধরনের কর অবকাশ সুবিধা দিয়ে এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করলেও রেয়াতযোগ্য পণ্যের নির্দিষ্ট তালিকা করেনি। এর ফলে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রত্যয়নপত্র থাকায় অরেয়াতযোগ্য পণ্যও খালাস হচ্ছে। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, বিদ্যুৎ বিভাগ শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানিতেই প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করছে। অরেয়াতযোগ্য কোনো পণ্য আমদানিতে প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা হচ্ছে না।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কর রেয়াত সুবিধায় রড, পাথর আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগের সত্যতা নেই বলে দাবি করেন বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারাও। ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বারাকা পাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানি চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এ অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অত্যাবশ্যকীয় যেসব পণ্য প্রয়োজন হয়, তা বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ঠিক করে দেয়। তাদের সনদ দেখে শুল্কমুক্ত পণ্য খালাস করে কাস্টম হাউজ। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে রড, পাথর আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।
বিদ্যুৎ কোম্পানির নামে রেয়াত সুবিধায় রড, স্টিল স্ট্রাকচার শুল্কমুক্ত আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের। এর ফলে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি এ খাতের উদ্যোক্তাদের।
বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বেশকিছু কোম্পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সরকারি অবকাঠামো নির্মাণে শুল্কমুক্ত রড ও বিভিন্ন ধরনের স্টিল স্ট্রাকচার আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করছে। এ অভিযোগ আমাদেরও রয়েছে। অথচ দেশীয় কোম্পানিগুলো সব ধরনের শুল্ক ও কর দিয়ে এ পণ্য উৎপাদন করছে। এমনিতে চলতি হিসাব বছরের বাজেটে রড উৎপাদনে করভার বাড়ানো হয়েছে। তাই রড ও স্টিল স্ট্রাকচারের দামও বেড়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় কম দামে বাজারে রড বিক্রি হওয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আমরা এনবিআরে অভিযোগও দিয়েছি। এ বিষয়ে এনবিআরের শক্ত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কর রেয়াতযোগ্য পণ্য ও অরেয়াতযোগ্য পণ্যের তালিকা প্রস্তুত করতে একটি কমিটি গঠন করেছে এনবিআর। এনবিআর, বিদ্যুৎ বিভাগ, কাস্টম হাউজ ও সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আট সদস্যের কমিটি এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানাবে।
এনবিআরের কাস্টমস নীতি বিভাগের সদস্য সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই এ খাতে বর্তমান রাজস্ব সহায়তা বহাল থাকবে। তবে আমাদের দেখতে হবে এ নীতির কোনো অপব্যবহার যেন না হয়। তাই রেয়াতযোগ্য পণ্যের তালিকা তৈরি করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। পাশাপাশি আগের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হবে।