কফি কিংয়ের মৃত্যুতে সামনে এল ভারতের নগদ অর্থের সংকট

বুধবার দক্ষিণ ভারতের নেত্রাবতী নদীর তীর থেকে উদ্ধার করা হয় ক্যাফে কফি ডের (সিসিডি) কর্ণধার ভিজি সিদ্ধার্থের মরদেহ। পুলিশের ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে হঠাৎ করেই চাপে পড়ে সিদ্ধার্থ এমন সিদ্ধান্ত নেননি। এ ঘটনার বহু আগে থেকেই তার ওপর আর্থিক চাপ বাড়ছিল, যার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন সিদ্ধার্থ। তার মৃত্যুর পর ভারতের অর্থনীতি ও আয়কর বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।

কফি ডে এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের বোর্ডের কাছে পাঠানো সিদ্ধার্থের লেখা ও সই করা একটি চিঠিতে জানিয়েছেন, তিনি মারাত্মক আর্থিক সংকটে ভুগছেন, যার ফলে তার ওপর ঋণদাতা ও একটি প্রাইভেট ইকুইটি পার্টনারের ‘তীব্র চাপ’ সৃষ্টি হয়েছে।

ওই চিঠিতে সিদ্ধার্থ লিখেছেন, ‘যারা আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তাদের প্রতিদান দিতে না পারায় আমি খুব দুঃখিত। আমি দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে যাচ্ছি, কিন্তু আজ সবকিছু ছেড়ে দিলাম।’ গত ২৭ জুলাই সিদ্ধার্থ এ চিঠি পাঠান এবং এর দুদিন পর তার নিখোঁজ সংবাদ বের হয়।

এদিকে সিদ্ধার্থের মৃত্যুর পর ‘আয়কর সন্ত্রাস’ নিয়ে সরব হয়েছে ভারতে শিল্পমহল ও বিরোধী দলগুলো। বাজেটে অতিধনীদের ওপর আয়করের বাড়তি বোঝা চাপানোয় শিল্পপতিরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। সিদ্ধার্থের মৃত্যুর কারণে সে ক্ষোভ বের হয়ে আসছে।

সিদ্ধার্ধের ব্যক্তিগত ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর আগের দুই বছর তিনি কতটা ব্যয় করেছেন। তার ঋণ উচ্চতর সুদে বারবার পুনঃতফসিলের প্রয়োজন পড়ছিল।

কফি ডের স্বল্পমেয়াদি ঋণ মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানান, ঋণ কমানোর জন্য মৃত্যুর আগের দুই সপ্তাহ মুম্বাইয়ে নিজের প্রায় সবকিছু ব্যয় করেছিলেন সিদ্ধার্থ। জুলাই ও আগস্টের পেমেন্ট বাকি ছিল তার। গত ৩০ জুলাই কফি ডের জরুরি বোর্ড মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বলা হয়, তারা আস্থাবান যে তারা তাদের সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে।

সিদ্ধার্থের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সামনে এল নগদ সংকট ও শ্লথগতির প্রবৃদ্ধির কারণে করপোরেট এলিটরা কতটা চাপে রয়েছে। সিদ্ধার্থ তার চিঠিতে ঋণদাতা ও স্টেকহোল্ডারদের চাপ বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়টি মোদি সরকারের জন্য মোটেই স্বস্তিকর নয়, কেননা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ভারতকে ‘ইকোনমিক পাওয়ারহাউজ’ বানাতে চান, যদিও দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ভালো না।

রেটিং এজেন্সি কেয়ার রেটিংসের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাদান সবনবিস বলেন, এটা শুধু ক্যাফে কফি ডের ঘটনা নয়, আরো একশর বেশি এন্টারপ্রাইজ রয়েছে, যাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অথবা কোম্পানি এমন পর্যায়ে রয়েছে যে, তারা ঋণ বা বিনিয়োগ পাচ্ছে না, এটি একটি বড় সংকট। আমরা এমন একটি পর্যায়ে রয়েছি, যখন অর্থনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

এশিয়ার তৃতীয় সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ভারত মার্চসহ টানা চার প্রান্তিক প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি দেখল। গত বছর ব্যাংকবহির্ভূত ঋণদাতা ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের পতনের পর থেকে ঋণদাতারা দুশ্চিন্তায় রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মন্দঋণের সমস্যা। এর প্রতিক্রিয়ায় রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া চলতি বছর সুদহার কমাতে যাচ্ছে।

ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে কৃষকের আত্মহত্যার খবর প্রায়ই ভারতের গণমাধ্যমে আসে। তবে ভারতের সুপরিচিত কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার আত্মহত্যা নির্দেশ করছে ঋণের পুনঃতফসিল শুধু দরিদ্র শ্রমিকদের নয়, শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। চিঠিতে সিদ্ধার্থ জানান, শেয়ার বাইব্যাক সম্পূর্ণ করার জন্য তাকে এক বন্ধুর কাছ থেকে মোটা অংকের ঋণ নিতে হয়েছে। শেয়ার বাইব্যাক প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রাইভেট ইকুইটি পার্টনার তাকে চাপ দিচ্ছিল।

সিদ্ধার্থের মৃত্যুর পর ভারতের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের বদলে টিকে থাকার জন্য ‘ফায়ার সেলের’ প্রতি বেশি নজর দেয়ার বিষয়টিও সামনে এনেছে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের অর্থনীতিতে ঋণের অন্যতম প্রধান উৎস। অন্যদিকে বিশ্বের মধ্যে ভারতের ব্যাংকগুলোয় মন্দঋণের বোঝা সবচেয়ে বেশি। এটিকে সামাল দিতে নীতিনির্ধারকদের বেগ পেতে হচ্ছে। অন্যদিকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে শুরু করে বড় করপোরেশন সবাইকে ঋণ পেতে সমস্যায় পড়তে হয়।

যদিও সিদ্ধার্থের ব্যক্তিগত অর্থায়ন সম্পর্কে এখনো সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে যতটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি অর্থায়ন নিয়ে সংকটে ছিলেন।

অন্যদিকে শেয়ারবাজারে দেয়া তথ্যানুসারে, চলতি বছর জুন পর্যন্ত সিদ্ধার্থ ও তার পরিবারের কাছে থাকা কফি ডের মোট শেয়ারের ৭৬ শতাংশ ঋণের জামানত হিসেবে ধরা হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৬০ শতাংশ।

সিদ্ধার্থের চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, কীভাবে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠছিল, একটি ইকুইটি পার্টনার তাকে কোম্পানির শেয়ার বাইব্যাকের চাপ দিচ্ছিল এবং আয়কর কর্তৃপক্ষ তাকে নাজেহাল করছিল। আয়কর কর্তৃপক্ষের কারণে তার নিজের একটি প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে বড় অর্থ সংকট সৃষ্টি হয়।

এ চিঠির প্রতিক্রিয়ায় কর্ণাটক ও গোয়ার আয়কর বিভাগ বলেছে, সিদ্ধার্থ ৩৬০ কোটি রুপির আয়বহির্ভূত অর্থের কথা স্বীকার করেছিলেন এবং অনাদায়ী কর পরিশোধে কফি ডের শেয়ার জামানত হিসেবে না রাখা পর্যন্ত তারা ওই প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি স্থগিত রেখেছিল।

বুধবার কফি ডের বোর্ড জানিয়েছে, ঋণ কমানোর জন্য তারা একটি কমিটি করেছে এবং চিঠিতে যেসব লেনদেনের কথা বলা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।

মুম্বাইভিত্তিক প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম ক্রাইসক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সঞ্জীব কৌল বলেন, নগদ অর্থের সংকট বাস্তবতা। আমরা ভারতে কৃষকের আত্মহত্যা নিয়ে কথা বলি, কিন্তু ব্যবসায় ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যার বিষয়টির দিকে আমরা কতটা নজর দিই? উদ্যোক্তারা খুব উদ্যমী হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা প্রায় ক্ষেত্রেই একা হয়ে পড়েন।

উল্লেখ্য, এক জার্মান কফি চেইন শপের মালিকের সঙ্গে আলাপচারিতার পর ভারতে নিজেদের কফি চেইন শপ চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সিদ্ধার্থ। ১৯৯৪ সালে ক্যাফে কফি ডে (সিসিডি) নামে বেঙ্গালুরুতে প্রথম কফি চেইন শপ চালু করেন তিনি। ট্যাগলাইন ছিল, এক কাপ কফিতে ঘটতে পারে অনেক কিছু (এ লট ক্যান হ্যাপেন ওভার এ কাপ অব কফি)।

আর ফিরে তাকাতে হয়নি সিসিডিকে। গত বছর নাগাদ ভারতের ২৪৫টি শহরে ১ হাজার ৭০০ আউটলেট দাঁড়ায় ভারতের বৃহত্তম এ কফি চেইনটির। তার বিপরীতে ভারতে স্টারবাকসের আউটলেট মাত্র ১৪৬টি। অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, মিসর, মালয়েশিয়া ও নেপালে রিটেইল আউটলেট রয়েছে কফি ডের। এছাড়া উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি বাজারে কফি রফতানি করে ভারতীয় এ কোম্পানিটি।

সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন