উপকূলীয় অঞ্চল : নিষিদ্ধ জালে বিপন্ন ডলফিনের জীবন

সাইফ বাপ্পী

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বড় দুর্গাপুর এলাকায় মোংলা নদীতে বুধবার রাতে ভেসে ওঠে একটি মৃত শুশুক। আট ফুট দীর্ঘ শুশুকটির মৃতদেহ উদ্ধারের পর দেখা যায়, এর দাঁতে জাল প্যাঁচানো। পরে বন বিভাগের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, মাছ ধরার জালে আটকে শ্বাসরোধে মারা গেছে শুশুকটি।

এভাবে নদীতে পেতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকে প্রায়ই মারা যাচ্ছে শুশুক ও ইরাবতী ডলফিন। বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চল ও তত্সংলগ্ন উপকূলীয় নদীগুলোয় এ দুই প্রজাতির ডলফিনের জালে আটকে মারা যাওয়ার ঘটনা তুলনামূলক বেশি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঘাতকের ভূমিকা পালন করছে নিষিদ্ধ কারেন্ট বা ফাঁস ও বেহুন্দি জাল (সেটব্যাগ নেট)।

স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিন নিঃশ্বাস নেয় পানির ওপর। এ কারণে নদী বা সাগরে সবখানেই ডলফিনগুলোকে একটু পরপর ভেসে উঠতে দেখা যায়। নদীতে বিচরণ করতে করতে অনেক সময় পেতে রাখা কারেন্ট বা বেহুন্দি জালে আটকা পড়ে শুশুক বা ইরাবতী। জালে আটকা পড়লে (শুশুকের ক্ষেত্রে ঠোঁট এবং ইরাবতীর ক্ষেত্রে পাখনা আটকে পড়ার প্রবণতা বেশি) নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য পানির ওপর মুখ তুলতে না পারায় দম বন্ধ হয়ে মারা যায় প্রাণীগুলো। অনেক সময় আবার জেলেরা আটকা পড়া ডলফিনের পাখনা কেটে দিচ্ছে। এতে সাঁতার কাটতে না পেরে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে প্রাণীটি।

যেকোনো নদীতে ডলফিনের উপস্থিতি সেখানকার বাস্তুসংস্থান, প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য নির্ণায়ক। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোয় শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন ও ইরাবতী—এ দুই প্রজাতির ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে দেশের ছোট-বড় নদ-নদীগুলোয় মিঠা পানির ডলফিন শুশুকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। অন্যদিকে ইরাবতী ডলফিন মূলত সমুদ্র উপকূলের প্রাণী হলেও নোনা-মিঠা পানির খোঁজে এগুলো উপকূলীয় নদীগুলোয় ঝাঁক বেঁধে চলে আসে। যদিও মাছ ধরার জালের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও বিষ প্রয়োগে মত্স্য শিকার বিপন্ন করে তুলছে জলজ প্রাণীটিকে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দেশে কারেন্ট জালে আটকে মারা গেছে ৯০টি জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী। এর মধ্যে ৬৩টিই শুশুক। আর ইরাবতী ডলফিন ১৬টি। এর মধ্যে ৫২টি ডলফিনের (৪০টি শুশুক ও ১২টি ইরাবতী) মৃত্যু হয়েছে সুন্দরবনে।

এভাবে কমে আসছে উপকূলীয় অঞ্চলে ডলফিনের সংখ্যা। ২০০১ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় সুন্দরবনের তুলনামূলক কম লবণাক্ত এলাকায় ২২৫টি শুশুকের উপস্থিতি শনাক্ত করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া কর্ণফুলী-সাঙ্গু নদী ব্যবস্থায় শুশুক দেখা গিয়েছিল ১২৫টি। অন্যদিকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত এক সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, সুন্দরবনে শুশুকের মোট সংখ্যা ১৫৯। এছাড়া সুন্দরবনসংলগ্ন বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা নদ-নদীর ২৯০ কিলোমিটার ভাটি এলাকায় শুশুক দেখা গেছে মাত্র পাঁচটি। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সমীক্ষা চালিয়ে হালদা নদীতে শুশুকের উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে ৫০টি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন কর্ণফুলী ব্রিজ থেকে হালদা নদীর মোহনা পর্যন্ত শুশুক দেখা গেছে মাত্র পাঁচটি। সাঙ্গু নদীতে কোনো শুশুক দেখা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, নদীর উজানে কয়েকটি শুশুকের অস্তিত্ব থাকতে পারে।

অন্যদিকে ২০০৬ সালের এক সমীক্ষায় সুন্দরবন এলাকায় ইরাবতী ডলফিন শনাক্ত হয়েছিল ৪৫১টি। অন্যদিকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত করা সমীক্ষায় সুন্দরবনে ইরাবতীর মোট সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে ১৯৮টি। এছাড়া সুন্দরবনসংলগ্ন বলেশ্বর, বিষখালী ও পায়রা নদ-নদীর ২৯০ কিলোমিটার ভাটি এলাকায় এ প্রজাতির ডলফিন দেখা গেছে আরো ৩০টি। ‘আইডেন্টিফাইং ডলফিন হটস্পট ইন সাউথইস্টার্ন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য প্রকাশ হয়েছে।

সমীক্ষাটি পরিচালনাকারী গবেষকদের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আজিজ। শুশুক ও ইরাবতী সুরক্ষায় ২০২০-২০৩০ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের করণীয় নিয়ে সম্প্রতি একটি অ্যাকশন প্ল্যানও প্রণয়ন করেছেন এ গবেষক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি কারেন্ট জাল, ইলিশ ধরা জাল বা এ ধরনের কিছু জাল আছে, যেগুলো ডলফিনের প্রধান শত্রু। কোনো এলাকায় এসব জালের উপস্থিতি যত বেশি দেখা গেছে, সেখানে ডলফিনের উপস্থিতি তত কম। ডলফিনরাও জালগুলোকে এড়িয়েই চলে। বিশেষ করে শুশুকের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে অতিমাত্রায় মত্স্য শিকার। নদীগুলোয় জালের ব্যবহার এত বেশি যে, শুশুকের পক্ষে এগুলো এড়িয়ে চলা মুশকিল। আবার মিঠা পানির প্রাণী হওয়ায় এর পক্ষে সমুদ্রে যাওয়াও সম্ভব নয়। এমন একটা অসুবিধার মধ্যেই টিকে রয়েছে শুশুক। এছাড়া শীতকালের দিকে যখন পানি কমে যায়, তখন ডলফিনগুলোকে তুলনামূলক গভীর এলাকাগুলোয় চলে যেতে হয়। মত্স্য আহরণ কার্যক্রমও তখন সেদিকেই থাকে সবচেয়ে বেশি।

সার্বিকভাবে নদীতে ডলফিনের উপস্থিতি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি নদীতে পানিপ্রবাহ কমছে। পলি জমে নদী গভীরতা হারিয়েছে। পানির গভীরতা না থাকলে আবাসস্থল হারিয়ে ডলফিন বাঁচতে পারে না। এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে জলজ বাস্তুসংস্থানের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে।

‘কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান ফর গ্যাঞ্জেস রিভার ডলফিন অ্যান্ড ইরাওয়াদ্দি ডলফিন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই অ্যাকশন প্ল্যান প্রতিবেদনে দেখা যায়, অপরিণামদর্শী নদীশাসন ও উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণেও ডলফিনের সংখ্যা কমছে। বিশেষ করে ভারতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ এক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া বাংলাদেশ অংশেও যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ ও নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের কারণে শুশুকের সংখ্যা কমেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন