দলীয় পারফরম্যান্সই হচ্ছে না

ক্রীড়া প্রতিবেদক

নিজেদের সেরা দল নিয়ে বিশ্বকাপ অভিযানে গিয়েছিল বাংলাদেশ। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে নিজেদের আগমনী বার্তাটাও যেন দেয়া হয়েছিল। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজেদের উদ্বোধনী ম্যাচে দারুণ এক জয় বাংলাদেশী সমর্থকদের মনের জোর আরো বাড়িয়ে দেয়। ক্রিকেটবিশ্বও এ জয়ের পর বেশ নড়েচড়ে বসতে শুরু করে। কেউ কেউ তো বলেই দিল, এ দল আর আন্ডারডগ নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। তবে সুদিন শেষ হতে বেশি সময় লাগেনি। পরপর দুই ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হার। শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচটি বাতিল হয়ে যায় বৃষ্টিতে। যদিও অনেকে সে সময় দাবি করেছিল, ম্যাচটা খেলা হলে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা ছিল উজ্জ্বল। কিন্তু লংকানদের বিপক্ষে শেষ তিন ম্যাচের ফল দেখে সেই দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানকে হারালেও আর কোনো সাফল্য নেই বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৩৩ রান করার তৃপ্তি থাকতে পারে কিন্তু বোলারদের দেয়া ৩৮১ রানের পাহাড় দেখলে সেই তৃপ্তিও বেশিক্ষণ থাকে না। ১০ দলের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অর্জন অষ্টম স্থান। কিন্তু এটুকুতেই সন্তুষ্ট বোর্ডপ্রধান, বিশ্বকাপও নাকি সফল! বিশ্বকাপের পর দেশে ফিরে নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বরং সমালোচকদের একহাত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু দলের পারফরম্যান্সে বোর্ডপ্রধানের যখন কোনো প্রশ্ন নেই, তখন যেসব প্রশ্ন মনে জাগে, তার উত্তর দেবে কে?

বোলিং নিয়েই আলাপ করাটা সহজ, কারণ নখদন্তহীন বোলিংয়ের ভালো দিক বের করাই যে মুশকিল। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ হবে জেনেও ২০১৫ সালের পর থেকে কোনো পরিকল্পনা ছিল না বোলিং নিয়ে। যেখানে প্রায় প্রতিটা দল ১৪৫-১৫০ কিলোমিটারের গতিময় পেসার নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেছে, সেখানে আমাদের পেসারদের ১৪০ পেরোতেই দম ফুরিয়ে যায়। তার ওপর অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে সিরিজটা কাটিয়েছেন বিশ্বকাপেই। মাশরাফির অফ ফর্ম, সঙ্গে সাইফুদ্দিন-মুস্তাফিজদের প্রয়োজনের সময় জ্বলে উঠতে না পারা। উইকেটের সংখ্যা দেখে অবশ্য বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ আছে। মুস্তাফিজ একাই নিয়েছেন ২০ উইকেট। কিন্তু তিনি ২০ উইকেটের ১০টিই নিয়েছেন শেষ দুই ম্যাচে। যখন ম্যাচ হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের শ্রী বাড়লেও দলীয় পারফরম্যান্সে তার কোনো প্রভাব ছিল না। একই অবস্থা সাইফুদ্দিনেরও। উইকেট পেয়েছেন কিন্তু রানও দিয়েছেন অনেক। এদিকে শুরু থেকেই দলের সঙ্গে ছিলেন আবু জায়েদ রাহী। কিন্তু নিজেকে প্রমাণের জন্য একটি সুযোগও পাননি তিনি। এরপর শ্রীলংকা সফরের দল থেকেও ছুড়ে ফেলা হয় তাকে। অর্থাৎ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেয়ে দল থেকে বাদ পড়েছেন কোনো ম্যাচ না খেলেই। কিন্তু কেন? তার কোনো উত্তর নেই। শ্রীলংকায় সুযোগ দেয়া হলো তাসকিন আহমেদকে। কিন্তু তাসকিনের একটি ম্যাচও খেলা হয়নি। উল্টো আকস্মিক উড়ে গিয়ে তিনটি ম্যাচই খেলে এসেছেন শফিউল ইসলাম। তাহলে স্কোয়াডে তাসকিনকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল কেন? বিশ্বকাপে দলগুলোর সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন লেগ স্পিনাররা। প্রায় প্রতিটা দল এক বা একাধিক লেগি নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশ গত চার বছরে বলার মতো একজন লেগ স্পিনার বের করে আনতে পারেনি। কেন ক্রিকেটপাগল একটা দেশে লেগ স্পিনার তৈরি হচ্ছে না, এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ারও কেউ নেই।

ব্যাটসম্যানদের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে বলতে হয় টপ অর্ডারদের কথা। তামিম-সৌম্য বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ফ্লপ। দু-একটা ম্যাচে হয়তো ভালো শুরু এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওইটুকুই। দুজনের ব্যাটই ছিল ম্লান। শ্রীলংকার বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে সৌম্য ৬৯ রান করেছেন। কিন্তু সেটিও তিন নম্বরে নেমে। অন্য ওপেনার তামিম কি তার সর্বকালের সবচেয়ে বাজে সময় পার করছেন কিনা, সে প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। দেশের অন্যতম সেরা এ ব্যাটসম্যান যে ব্যাটিংই ভুলে গেছেন! টানা ছয় ইনিংসে আউট হয়েছেন স্টাম্প উপড়ে। অনেকেই তামিমকে বিশ্রাম দেয়ার দাবি করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থে তামিমের ফেরাটা বড্ড জরুরি, সেটা কিছুদিনের বিশ্রাম নিয়ে হলেও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তামিমকে না হয় বিশ্রাম দেয়া হলো, তার বিকল্প কে? এনামুল হক বিজয় ঘরোয়া ক্রিকেটে যতটাই উজ্জ্বল, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ঠিক ততটাই নিষ্প্রভ। মোহাম্মদ মিঠুনের প্রতিভার কথা কেবলই শোনায় যায়। দু-এক ম্যাচে ইঙ্গিত দিয়ে দীর্ঘ নীরবতা। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সেরা ফর্মে নেই অনেকদিন। আছে চোটের ধকলও। যুক্ত হয়েছে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টিও। এত ঝামেলা কাটিয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন, সে প্রশ্নও চলে আসে। নিচের দিকে সাব্বির রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ কিংবা মোসাদ্দেক হোসেন বরাবরই ছায়ার নিচে। এদের মাঝে মিরাজই হয়তো বল কিংবা ব্যাট হাতে কিছুটা ধারাবাহিকতা দেখাতে পেরেছেন। কিন্তু তাতে ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্স কতটা, তাও ভাবা দরকার। এর বাইরে থাকল কেবল সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কৃতিত্বের বেশির ভাগই যাবে সাকিবের দখলে। কিছুটা পেতে পারেন মুশফিক। লংকায় সাকিব না থাকায় প্রথম দুই ম্যাচে মান বাঁচিয়েছেন মুশফিক। কিন্তু এ দুজনের কাঁধে ভর করে আর কত? বাকিরা জাগবেন কবে কিংবা বিকল্পই-বা কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোচ প্রসঙ্গ। কোচ যে কতটা স্বাধীন ছিলেন, বিসিবিপ্রধানের সংবাদ সম্মেলনেই সেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কেবল বোর্ডের মন রেখে চলতে না পারার কারণে বাদ পড়তে হয়েছিল তাকে। নয়তো বোর্ডে রেজাল্ট কার্ডে ‘সফল’ বিশ্বকাপে কোচের ‘অসফল’তার যে ব্যাখ্যা, তাও ঠিক বোধগম্য হয় না।

হোয়াইটওয়াশের ব্যর্থতা নিয়ে গতকাল দেশে ফিরেছেন তামিমরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন