অর্থশাস্ত্রে গণিতের ব্যবহারে কি অর্থনীতিবিদের ভূমিকা হ্রাস পাচ্ছে?

রবার্ট স্কিডেলস্কি

গত জুনে মারা যাওয়া ইতিহাসবিদ নরম্যান স্টোন সবসময় ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের বিদেশী ভাষা শেখায় জোর দিতেন। ভাষা কোনো দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য জানা-বোঝায় শিক্ষার্থীদের অভিগম্যতা দেয়। কোনো দেশের ইতিহাস আমাদের জানায় দেশটি কীভাবে নিজেকে ও অন্যদের দেখে। ভাষাজ্ঞান এভাবে একজন ইতিহাসবিদের গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি সরঞ্জামের উপকরণ হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অতীত ও ভবিষ্যৎ বোঝারও এটিই হলো চাবিকাঠি।

এমনকি ইতিহাসবিদদের মধ্যেও সুনির্দিষ্ট ভাষা জানার মৌলিক গুরুত্বের এ বিশ্বাস সময়পরিক্রমায় বিবর্ণ হয়েছে। কম-বেশি সব সামাজিক বিজ্ঞানই একটি সর্বজনীন ভাষার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়েই শুরু হয়, যা দিয়ে ওই বিশেষ বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামতগুলো প্রকাশ পায়। ওইসব বিষয়ের (পড়ুন সামাজিক বিজ্ঞান) জ্ঞানের মডেল এভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সূক্ষ্মতা-যথার্থতা ও সাধারণত্ব আকুলভাবে কামনা করে। কিছু সর্বজনীন ও গুরুত্বপূর্ণভাবে কিছু অনৈতিহাসিক বিষয়ের দিক থেকে একবার মানুষের আচরণ বুঝতে পারলে আমরা সেটিকে নিয়ন্ত্রণ (এবং অবশ্যই উন্নয়নও) করতে পারি।

এটা সত্য যে অর্থনীতির চেয়ে আর কোনো সামাজিক বিজ্ঞানই এ প্রণোদনা বা প্রলোভনে এত প্রবলভাবে নিমজ্জিত হয়নি। অর্থনীতির সর্বজনীন ভাষা হলো গণিত। এর (পড়ুন অর্থনীতির) মানব আচরণ সম্পর্কিত মডেলগুলো কেবল গভীর পর্যবেক্ষণ নয়, বিভিন্ন অনুমান বা প্রকল্পের ওপর নির্মিত। সেগুলো সম্পূর্ণ হাওয়া থেকে না হলেও অসচেতনভাবে অর্থনীতিবিদদের বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে আহরিত। পরবর্তী সময়ে এসব মডেল ‘সব ভেড়া সাদা, কাজেই পরবর্তী যে ভেড়ার সঙ্গে আমার দেখা হবে, সেটিও সাদা হবে’—এ ধরনের যৌক্তিক ভিত্তির আকার নেয়। অর্থনীতির ধারণা অনুযায়ী সব মানুষই উপযোগ সর্বোচ্চকারী। অতএব যেকোনো অবস্থায় যেকোনো সময় মানুষ এমনভাবে কাজ করবে, যাতে তারা নিজেদের উপযোগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। এ পদ্ধতি অর্থনীতিকে একটি অভিনব পূর্বাভাসমূলক ক্ষমতা দিয়েছে, বিশেষ করে যাতে উপযোগগুলো সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ ও পরিমাণগতভাবে ম্যানিপুলেট হতে পারে। পল স্যামুয়েলসনের ভাষায়, এ গুণটি অর্থনীতিকে ‘সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর রানী’ বানিয়েছে।

মূলনীতির দিক থেকে অর্থনীতিবিদরা নিজেদের সিদ্ধান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন না। প্রত্যেকে ভাবতে পারেন যে এক্ষেত্রে ইতিহাস বিশেষভাবে উপকারী হবে। ঘটনা সত্যিই কি এই যে প্রতিটি জায়গায় এবং দেশে সব ভেড়া সাদা? কিন্তু গালগল্পের চেয়ে অধিকতর ভালো হলেও অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ ইতিহাসের ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ’ অবজ্ঞা করেন। তারা ইতিহাসের দিকে এগিয়ে যান কেবল একটি পথে। আর তা হলো ইকোনমেট্রিকস। এ পদ্ধতিতে অতীত বড়জোর তাদের কাছে পরিসংখ্যানিক অনুসন্ধান।

অর্থনীতিবিদ রবার্ট সলো ইকোনমেট্রিকসের সঙ্গে অর্থনৈতিক ইতিহাস চিহ্নিতকরণের একটি চমত্কার পর্যালোচনা হাজির করেছেন এবং যেমনটা তিনি বলেন, ‘ইতিহাস অন্ধ’। এক্ষেত্রে তার একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ প্রয়োজন মনে করছি, ‘এ পেশার সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতীরা এমনভাবে এগোয় যেন অর্থনীতি সমাজের পদার্থবিদ্যা। এখানে সর্বজনীনভাবে বৈধ একটি একক মডেল আছে। এটি কেবল প্রয়োগ করলেই হবে। আপনি একজন আধুনিক অর্থনীতিবিদকে তার কম্পিউটারসহ যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে একটি টাইম মেশিনে ফেলে দিন। এমনকি সময় কত ও কোন স্থান জিজ্ঞাসা করা ছাড়াই কোনো কাজ বা ব্যবসার সে একটি অবয়ব (সেট-আপ) অবশ্যই দাঁড় করাতে পারবে।’  

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বেশির ভাগ ঐতিহাসিক মডেলিংয়ের ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা অনুমান করেন যে আজকের মতো অতীতের মানুষের আবশ্যিকভাবে একই মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্য ছিল। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস এ অ্যাপ্রোচের একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, ‘ইন্টারেক্টিং রোবটদের দ্বারা একটি যান্ত্রিক, কৃত্রিম বিশ্ব গঠন, যেটি বাস্তব বিশ্বের মতো আচরণের সার্বিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনে সমর্থ।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন