ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা : অধিকার সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার

গত দুই দশকে দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দৃশ্যমান। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় সরকারি হিসাবে বর্তমানে সার্বিক দারিদ্র্য হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। সেই বিবেচনায় সাড়ে তিন কোটির অধিক মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, উল্লিখিত সংখ্যক দরিদ্রের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর। আগের ধারণা অনুযায়ী, দরিদ্রপ্রবণ জেলা মানেই শীর্ষে থাকবে কুড়িগ্রাম। এখন এ বিন্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দিনাজপুরে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস। এর অন্যতম কারণ হলো, সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, যেসব জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পিছিয়ে পড়া দলিত জনগোষ্ঠীর বাস বেশি, সেসব জায়গায় দারিদ্র্য সংঘটনের হার বেশি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। সেগুলো হলো ভূমিতে তাদের অধিকারহীনতা, সামাজিক সংস্কৃতিতে প্রবেশগম্যতায় বাধা, তাদের চিরায়ত জীবিকার উৎসগুলোর ক্রমাগত সংকোচন ও হরণ এবং সর্বোপরি মানবমর্যাদার অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়টি এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠা না পাওয়া। মূলত এসব কারণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রান্তিক দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষ দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ এবং উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত হতে পারছে না কিংবা উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন এক বাস্তবতায় বণিক বার্তার আয়োজনে অনুষ্ঠিত সংশ্লিষ্ট গোলটেবিল বৈঠকে যথার্থভাবে বক্তাদের ভাষ্যে তাদের অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিতের কথা উঠে এসেছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সক্রিয়তা প্রত্যাশিত।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একটি বড় অংশই একসময় ছিল অরণ্যচারী। সাঁওতাল, গারো, ওঁরাও প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীর অরণ্যনির্ভরতার কথা অজানা বিষয় নয়। কিন্তু বনভূমিতে তাদের সনাতনী অধিকার স্বীকৃত নয়। অথচ বনায়নের সুযোগে ও শিল্পায়নের কারণে বনভূমির একটি বিরাট অংশ চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের হাতে। কীভাবে বনের বিনাশ ঘটে চলেছে, কারা এজন্য দায়ী এবং সত্যিকারের বন প্রতিষ্ঠার কোনো উপায় আদৌ আছে কিনা, তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি তত্পর হতে হবে রাষ্ট্রকে। এদিকে ভূমিহীনতা ও ভূমিবিরোধকে কেন্দ্র করে হত্যাসহ সহিংসতা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি সাধারণ সমস্যা, যা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি দীর্ঘদিনের। এজন্য অনেকেই সরকারের কাছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। ভূমি কমিশনের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু সরকার আন্তরিক না হলে ভূমি কমিশন কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে আছে সংশয়।

বণিক বার্তার গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় নৃগোষ্ঠী ও দলিত জরিপ পরিচালনা, তাদের জন্য জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, বিশেষ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা, প্রথাগত ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করে তাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, মৌলিক মানবাধিকার ও নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন, বিশেষ সেবা ও কোটা সংরক্ষণ, জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ, ভূমি-প্রতিবেশ ও পরিবেশ রক্ষা এবং প্রস্তাবিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আইন ও বর্ণবৈষম্য বিলোপ আইনে সংশ্লিষ্ট পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের সুপারিশ এসেছে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় এসব সুপারিশ বিবেচনা করা যেতে পারে।

এদিকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সুরক্ষা দেয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আন্তর্জাতিক সনদ ও জাতীয় আইন আছে। এদের প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কী দায়িত্ব, তার নির্দেশনাও আছে এসব সনদ ও আইনে। কিন্তু এসব সনদ ও আইন এবং সেসবের বাস্তবায়নের জন্য কী নীতি ও কাঠামো এবং কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া থাকতে হবে, সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। উল্লিখিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্য নিরসনে প্রয়োজন হলে নতুন আইনও প্রণয়ন করতে হবে। আবার শুধু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা আইন প্রণয়ন করলেও হবে না, তাদের সঙ্গে নিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনসাধারণের মানসিকতার বদলও আবশ্যক। বর্তমানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রম বলবৎ রয়েছে। এ ধরনের আর্থিক সহায়তায় তাদের অবস্থার সাময়িক উন্নতি হতে পারে বটে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ওইসব জনগোষ্ঠীর অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা প্রদান। মনে রাখতে হবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন করা না গেলে সামগ্রিক উন্নয়ন যেমন টেকসই হবে না, তেমনি অন্তর্ভুক্তিমূলকও হবে না। কাজেই বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই।    

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন