সম্পাদকীয়
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি সচল রাখতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। বর্তমানে বিদেশী বিনিয়োগে বিশ্বের প্রায় সব দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে নিয়মকানুনের জটিলতা হ্রাসসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার চেষ্টা চলছে। দেশের অর্থ দেশেই বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দেশী বিনিয়োগকারীদের জন্যও ব্যবসার যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশকে বিনিয়োগবান্ধব হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য আইনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, প্রতিযোগী অন্যান্য দেশ এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসা করার পরিবেশ নিয়ে প্রতি বছর সমীক্ষা ও প্রতিবেদন বা ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। ব্যবসা করার পরিবেশ বিবেচনায় বিভিন্ন দেশের বৈশ্বিক র্যাংক ও বিভিন্ন সূচকে অবস্থান প্রকাশ করা হয়। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ ডুয়িং বিজনেস সূচকে কোন দেশের কী অবস্থান, তা বিবেচনায় রাখেন। সর্বশেষ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা করার সূচকে মাত্র এক ধাপ উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। অথচ বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোয় লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। এক্ষেত্রে মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের কথা বিশেষভাবে বলা যায়। বিশ্বব্যাংকের র্যাংকিংয়ে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম, সেখানে আফগানিস্তানের অবস্থান ১৬৭তম ও মিয়ানমারের ১৭১তম। আফগানিস্তানের উন্নতি উদাহরণ সৃষ্টিকারী। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও চলমান সামাজিক অস্থিরতার মধ্যেও দেশটি এই যে উন্নতি করেছে, তার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে ব্যবসাবান্ধব বিভিন্ন সংস্কার। প্রশ্ন হতে পারে, আফগানিস্তান পারলে আমরা পারছি না কেন? র্যাংকিংয়ে এবার এক ধাপ উন্নতি হয়েছে বটে, তবে গত বছরের প্রতিবেদনগুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে বাংলাদেশ একই অবস্থানে আটকে রয়েছে। অথচ ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার ডুয়িং বিজনেস সূচকে উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ৯৯তম অবস্থানে আসার। কিন্তু এ লক্ষ্য পূরণে যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি, তা প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্যবসা সহজীকরণের বাধাগুলো দূরীকরণে জাতীয়ভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বেশকিছু সুপারিশও করেছে এবং সে অনুযায়ী কিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু যেটা হয়নি তা হলো, কার্যকর বাস্তবায়ন। পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের উন্নতির পথে ক্রমেই বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। অথচ এগিয়ে যাওয়া দেশগুলো গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বলেই উন্নতি করেছে। সরকারকে দ্রুততম সময়ে ব্যবসার বাণিজ্যিক বিরোধ মেটানো ও আইনি জটিলতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জমি নিবন্ধন, নির্মাণ অনুমতি, কর প্রদান ও ইউটিলিটি সেবা এবং চুক্তি কার্যকরের বিষয়টিতে নজর দিতে হবে। বিপুল জনগোষ্ঠীর দক্ষতার যথাযথ ব্যবহার, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট নিরসন, অবকাঠামোগত উন্নতি, দুর্নীতি এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর, ব্যাংকিং ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা রোধ করা গেলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ অনেকটাই নিশ্চিত করা যাবে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আরো নজর দিতে হবে ঋণপ্রাপ্তি সহজীকরণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার দিকে। মনে রাখতে হবে নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জন কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ ছাড়া সম্ভব হবে না। বিশ্বব্যাংকের র্যাংকিংয়ে উন্নতির জন্য প্রতিটি সূচকের ওপর আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে।
দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রতিযোগী দেশগুলো যে হারে সংস্কার করছে, বাংলাদেশ তা করতে না পারলে অবধারিতভাবে পিছিয়ে পড়বে। সুতরাং বাংলাদেশকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় উভয় সরকারকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে পদক্ষেপ বাস্তবায়ন বা সংস্কার কঠিন হবে না।
পাঠকের মতামত