প্রথম পাতা, চট্টগ্রাম

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা ভোটার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ সত্ত্বেও তাদের ভোটার হওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম অঞ্চলের চার জেলার ৩২ উপজেলায় ভোটার হওয়া ২৪৩ রোহিঙ্গাকে এরই মধ্যে শনাক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাদের কারোরই জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার কথা না থাকলেও তারা নিবন্ধিত হয়েছে সঠিকভাবেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থের বিনিময়ে দালালের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করছে রোহিঙ্গারা। এসব নথি কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হচ্ছে তারা। ঘটনাগুলো সামনে আসার পর টনক নড়েছে ইসির। বর্তমানে ইসির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কার্যালয়গুলো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক অনুসন্ধানে প্রথম ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি উঠে আসে। এরপর বিষয়টি নিয়ে ইসি বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিটি আমলে নিয়ে বিষয়টির তদন্ত শুরু করেছে জেলা নির্বাচন কমিশন। এতে অনেক সতর্কতার মধ্যেও বেশকিছু রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধরা পড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে। এর পরও অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করছে রোহিঙ্গারা। এসব কাগজপত্রের ভিত্তিতেই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করছে তারা। এ অবস্থায় মাঠ পর্যায়ে জন্মনিবন্ধন সনদ ও ইউনিয়ন পরিষদের জাতীয়তা সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার দাবি উঠছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ভোটার হয়েছেন মোহাম্মদ ইসমাইল ও আবু তালেব। তাদের মধ্যে মোহাম্মদ ইসমাইল ভোটার হয়েছেন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসেবে। তার বরাদ্দ পাওয়া ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ১৯৮৯০৩১৫১৩১২৯৪৪০০, ভোটার নম্বর ০৩০২১১২৯৪৪০০। একই ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসেবে ভোটার হয়েছেন আবু তালেব। তার অধিকারে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ১৯৫৮০৩১৫১৩১৩০১৪০০, ভোটার নম্বর ০৩০২১৫৩০১৪০০। তালিকায় সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা হিসেবে তাদের নাম এসেছে।
এ দুই ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর পরও কেউ ভোটার হয়ে থাকলে জনপ্রতিনিধিরা দায়ী নন। অভিযুক্তরা দালালদের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা। বিষয়টির খোঁজ নেয়া হলে ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে কয়েকজনের বাবা বা পূর্বপুরুষের মিয়ানমারে যাতায়াত ছিল। মিয়ানমারের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় তারা এখানে এসে ভোটার হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন পৈতৃক পরিচিতি ব্যবহার করে ভোটার হলেও অন্যদের অবস্থান ও পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন তিনি।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় পর্যায়ে দালালের হাত ধরে টাকার বিনিময়ে ভোটার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারা। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে (চট্টগ্রাম অঞ্চল) একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত হওয়া ২৪৩ ভোটারের নাম, ভোটার নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ভোটার হওয়ার এলাকার নাম ও ওয়ার্ড-ইউনিয়নের নাম দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বিভিন্ন কৌশলে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রশাসনের নজরদারি থাকলেও অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করা হচ্ছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিভিন্ন বাধা উপেক্ষা করে রোহিঙ্গারা ভোটার হচ্ছে, জাতীয় পরিচয়পত্র পাচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্রের সঠিকতা পেলে নির্বাচন কমিশনেরও কিছু করার থাকে না।’
বিবিএস থেকে পাঠানো তালিকায় থাকা বিভিন্ন উপজেলার একাধিক ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ঢল নামার পর গত কয়েক মাস আগে অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে কক্সবাজারের পাসওয়ার্ড লক করে দেয়া হয়। এর পরও দালালদের মাধ্যমে ভোটার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে কেউ কেউ পাসপোর্টও গ্রহণ করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
অবৈধভাবে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের তালিকায় দেখা যায়, শুধু কক্সবাজার বা বান্দরবান নয়, চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন এলাকায়ও রোহিঙ্গা হিসাবে শনাক্ত হয়েছে অনেক ভোটার। এর মধ্যে নাসিরাবাদ, জালালাবাদ, চান্দগাঁও, মৌলভীপাড়া, হালিশহর, কাট্টলী, শুলকবহর, পতেঙ্গা, কাটগড় এলাকায় একাধিক ব্যক্তি রোহিঙ্গা ভোটার হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় দালালদের টাকা দিয়ে তারা ভোটার হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন ইসি কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাতেও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে আসা রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে ভোটার হতে এসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে মিয়ানমারের পাঁচ-ছয়জন বাসিন্দা। চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা টাকার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে বিভিন্ন মাধ্যমে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছে। গত কয়েক মাসে আমরা এ ধরনের পাঁচ-ছয়জন রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করেছি। আমরা তাদের আবেদন বাতিল করে দিয়েছি।’
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা প্রাথমিক ভাবে রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত হলেও অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের সহকারী পরিচালক আরাফাত আরা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিশেষ কমিটির মাধ্যমে অভিযুক্ত ২৪৩ ভোটারের তথ্য যাচাই করে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দিতে অনুরোধ জানানো হয়। তালিকাটি এরই মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন কার্যালয়গুলোয় পাঠানো হয়েছে। ভোটার তালিকায় দেয়া তথ্যের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের গরমিল পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল হবে বলে জানিয়েছে আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন কার্যালয়।
পাঠকের মতামত