সম্পাদকীয়
29 Shares

বিশ্বসমাজে মানুষ তিনটি লিঙ্গে বিভক্ত। নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গ। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অনেকটা অগোচরে থাকে। যদিও আমাদের এ শহরে কয়েক বছর ধরে নানা কারণে এরা আলোচিত। সেই সঙ্গে খুবই নগণ্য সংখ্যায় চলাফেরায় নিত্যই গোচরীভূত।
নারী আর পুরুষের বসবাসেই বিশ্বসংসার ও সমাজ আবৃত, আদৃত। পুরুষ শাসিত বিশ্বে নারী নির্যাতন আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য নারীদের পাশাপাশি নারীবাদী হাজারো পুরুষ যুদ্ধে শামিল। একদিকে নারীদের অধিকার আদায়ের বৈপ্লবিক ধারা আনয়নের হুলুস্থুল প্রচেষ্টা, অন্যদিকে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অবলীলায়— প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। কখনো আঁধারে, কখনো দিন-দুপুরে হাজারো চোখের সামনে, হাজারো নাকের ডগায়। ঘটনা ঘটে, আমরা প্রতিবাদে মুখর করি সড়ক, জনপথ, মানববন্ধন করি, পত্রিকা, টকশোতে ঝড় তুলি, তারপর আপন বলয়ে বিভোর হয়ে যাই কিছুদিন বাদেই। কখনো কখনো ঘটনার জন্য নারীটিকে দায়ী করি, তাও অনেকটা খোলামেলা ও নির্লজ্জভাবেই। পোড়া কলিজায় দগদগে এক দাগ নিয়ে কেটে যায় নির্যাতিতার পরম আত্মীয়দের, যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন। আইন ঘুরে বেড়ায় ধূম্রজালে। সর্বক্ষেত্রেই আড়াল হয়ে যায় নির্যাতনকারী।
সমসাময়িককালে রুপার বিষয়টি দ্রুত নিষ্পন্ন করার প্রচেষ্টা ছিল আশাবাদের, সেটির পেছনেও দেখা গেছে নির্যাতনকারীরা ছিল সমাজের এমন এক স্তরের, যাদের আড়াল করার কেউ ছিল না। নির্যাতিতার আরেকটি ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে ঘটনা-পরবর্তী ধারা। নির্যাতিত নারীটি আরো বেশি নির্যাতনের মধ্যে কালাতিপাত করে কখনো আমাদের সহমর্মিতার ছটায়, কখনো সমাজের বাঁকা দৃষ্টিভঙ্গির কালো ছায়ায়। মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে প্রায় সবক্ষেত্রে আমরা খুঁজে বেড়াই নারীটির কী কী দোষ ছিল। অন্যদিকে নারী নির্যাতনের বিরাট এক অংশকে আমরা আমলেই নিই না এগুলোকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের হিস্যা ভেবে। করপোরেটে, বিভিন্ন অফিস-আদালতে কর্মরত নারী কর্মীদের নির্যাতিত হতে হয় পুরুষ কর্মীদের বাক্যে, চোখের ভাষায়, শরীরের ভঙ্গিতে, হাস্যরসে। আপনি কোনো দাপ্তরিক কাজে আপনার নারী সহকর্মীকে বাইরে কোথাও পাঠানোর আগে তাকে প্রেষণা দিতে গিয়ে এমন শব্দাবলি বা বাক্য ব্যবহার করলেন, যা নারী কর্মীটির নারীত্বে আঘাত হানে বা প্রমাণ করে, তার নারী সৌন্দর্যকে আপনার বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রয়োগ করার কৌশল হিসেবে কোনো অসঙ্গত ধারা এতে আছে, তবে এটিও নির্যাতন এবং আমি সরাসরি বলতে দ্বিধা করি না, এ ধান্ধা কোনো নারী কর্মীর সঙ্গে আকার-ইঙ্গিতে কোনো সম্পর্ক স্থাপনের অভিপ্রায়ের সমান নির্যাতন। মাতৃত্বকালীন কোনো নারীকে বেতন-ভাতা ও দাপ্তরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাও অপরাধ ও নির্যাতনের শামিল। এ পর্যন্ত বলা কথার পেছনে যে মূল লেখা আজকের, তা সবে শুরু করছি। বেশ কিছুদিন আগে আমার সেলফোনের মেসেঞ্জারে একটি খবর পাঠান আমার এক বন্ধু। খবরটি হচ্ছে, কোনো এক তরুণ নির্যাতিত হয়েছেন তিন নারী দ্বারা। সম্ভবত কোনো ট্যাক্সিতে ঘটেছে ঘটনাটি এবং এ খবরের তথ্যসূত্র দেখাচ্ছে বহুল প্রচারিত এক সংবাদপত্রের অনলাইন প্রচারকে। তথ্যসূত্র নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। তবে যেটি নিশ্চিত, এ ঘটনায় হয়তো আমরা পুরুষরা এখনো তেমনটা ভীত নই। নাদিয়া (আইডি) নামে এক নারী এ ঘটনার খবরকে কেন্দ্র করে কমেন্টে বলেছেন। ‘নিশ্চয়ই বেপর্দা হয়ে বেহায়াদের মতো চলাফেরা করত ছেলেটি। একা এতগুলো মেয়ের সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠতে গেল কেন? মেয়েগুলো কি তার বোন ছিল? বেহায়াদের মতো চলাচল করলে এমন তো হবেই। ধার্মিকভাবে চললে, পোশাক শালীন হলে, ছেলেটির আজ এ দশা হতো না।’
আমি জানি, নাদিয়াও জানে এ সংসারজগতের প্রায় সবাই এটিকে হাস্যরসের খোরাক হিসেবেই দেখবে, দেখছে ...।
কিন্তু নাদিয়ার এ ব্যঙ্গ, এ বিদ্রূপাত্মক সরস কথার মধ্যে নারীদের নির্যাতিত হওয়ার পরবর্তী আলোচনাগুলোই তুলে ধরেছে। এর মধ্য দিয়ে নারীকে দুর্বল এবং আবদ্ধ রাখার বিরাট প্রক্রিয়ার যেন বহমান এক স্বীকৃত সত্য ধারাই প্রকাশিত। আমরা অনেক সভ্য, সুধী, শিক্ষিতজনরাও মনন-মগজে এখনো এ চিন্তাধারাকেই লালন করে আসছি, বুলিতে আমরা যতই আলাদা রকম নারী অধিকার সংস্কারের মাতম তুলি না কেন। নাদিয়ার এ মন্তব্য আমাদের পুরুষদের অনেক ভাবনার জায়গা তৈরি করে দিয়ে গেছে। নাদিয়া তোমায় অভিবাদন। নাদিয়ারা কহ...। কহিতে কহিতে কোনো একদিন, নারী দাঁড়াবে ঘুরে, সম অধিকারী রূপে।
লেখক: সাবেক ব্যাংকার
পাঠকের মতামত