প্রথম পাতা
559 Shares

সেকালে কার কত ক্রীতদাস আর রত্নরাজি ছিল, তা দিয়েই সম্পদের হিসাব হতো। এ যুগে ধনকুবেরদের ঐশ্বর্যের প্রকাশ ঘটে সুপারইয়ট, জেট ও অবকাশকেন্দ্রের ফিরিস্তিতে। সম্পদ ও সম্পদশালীর সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের বয়ান— জন ক্যাম্পফনারের
দ্য রিচ অবলম্বনে ধারাবাহিক আয়োজন
অন্যের সম্পদ লুট করে মানুষ ধনী হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেমন, তেমনি জাতীয় ও মহাদেশীয় পর্যায়েও লুণ্ঠনবৃত্তির অসংখ্য নজির রয়েছে। আর্থিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ লুটের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ইউরোপীয়দের হাতে ঘটে। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে স্প্যানিশ ও পর্তুগিজরা আমেরিকা মহাদেশে লুটের যজ্ঞ শুরু করে। তাদের মাধ্যমে সেদিনের নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে ওল্ড ওয়ার্ল্ডে অপরিমেয় পুঁজি ও সম্পদ স্থানান্তর হয়। এর জোরেই পরবর্তী পাঁচ শতকে বিশ্বজুড়ে ওল্ড ওয়ার্ল্ড শক্তিগুলোর দাপট নিশ্চিত হয়।
ইউরোপ থেকে আটলান্টিকের অন্য পাড়ের উদ্দেশে সবার আগে পাল তুলেছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। সমুদ্রযাত্রার প্রয়োজনীয় রসদ ও সমর্থনের জন্য কলম্ব্বাস পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন ও ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম হেনরির দরবারে তদবির করেন। এসব তদবির মূলত লুণ্ঠনবৃত্তির প্রকল্প প্রস্তাবনা। পর্তুগাল ও ইংল্যান্ডে তদবিরে ব্যর্থ হয়ে কলম্বাস কাস্তিলের রানী ইসাবেলার শরণাপন্ন হন। ইসাবেলা এবং তার স্বামী ও আরাগনের রাজা ফার্দিনান্দ কলম্বাসকে বার্ষিক ১২ হাজার মারভেদিস (স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা) মঞ্জুরি দিতে রাজি হন। দখলকৃত জায়গায় তারা কলম্বাসকে গভর্নর হওয়ার এখতিয়ার দেন। এছাড়া কলম্বাস যত স্বর্ণ ও রৌপ্য পাবেন, তার ১০ শতাংশ তাকে রাখার অনুমতি দেয়া হয়। ‘কাপিতুলেসিয়ন দো সান্তা ফে’ নামের এ চুক্তিতে শর্ত থাকে যে, যত স্বর্ণ ও রৌপ্য পাওয়া যাবে, কাস্তিলের রানী ও আরাগনের রাজাকে তার কমপক্ষে পাঁচ ভাগের এক ভাগ দিতে হবে।
কলম্বাসের গল্প অনেকেরই জানা। কোনো রকম স্বীকৃতি দূরের কথা, তিনি মারা গেছেন সুযোগ-সম্মান হারিয়ে, জেল খেটে। কলম্বাসের মাধ্যমে স্পেনের জন্য হরিলুটের সুযোগ উন্মোচন হয় আমেরিকা মহাদেশে। অসংখ্য অভিযাত্রী ও ভাগ্যানুসন্ধানী স্পেন থেকে নতুন মহাদেশে পৌঁছে। গোড়ায় এ তস্করবৃত্তিতে পৌরোহিত্য করে স্পেনের রাজপরিবার। কারণ লুটের সম্পদে তারাই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে।
রাজকীয় অনুমোদন নিয়ে যাওয়া দলগুলোয় পেশাদার সৈন্য, নাবিক, হিসাবরক্ষক ও যাজকরা থাকতেন। যাজকদের রাখা হতো স্থানীয়দের ধর্মান্তরের জন্য। স্থানীয়দের ওপর ইউরোপীয়দের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের স্বার্থে ধর্মান্তর জরুরি ছিল। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে স্পেনের সমাজ ছিল অনড়, রক্ষণশীল। এ কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষরা চাইত নতুন কোথাও থিতু হতে। কারণ সেখানে তারা নতুন পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। উপরন্তু ছিল ভূমি, পত্নী, উপপত্নী ও ক্রীতদাসপ্রাপ্তির অপার সুযোগ। খুব কম লোক স্পেনে ফেরার কথা মাথায় রেখে সমুদ্র পাড়ি দিত। একেবারে শুরুতে কলম্বাসের সঙ্গীদের মধ্যেই এ প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। তাদের অনেকে জাহাজের পাল তোলার আগে নিজেদের বন্দুক ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করে দেয়।
মধ্যযুগে ইউরোপের লুট-অভিযানে বিভিন্ন পরিবারের কয়েকজন অবৈধ সন্তান বিশেষ নাম করেন। নরম্যানদের ইংল্যান্ড বিজয়ে অ্যালান রুফুস ও তার ভাই ব্রিয়েন বিশেষ সাফল্য দেখান। একইভাবে স্প্যানিশদের আমেরিকা লুটে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন ফ্রান্সিসকো পিজারো ও তার তিন ভাই।
পিজারো ভাইদের জন্ম স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এক্সত্রেমাদুরা প্রদেশে। ফ্রান্সিসকো পিজারো যখন সর্বোচ্চ সাফল্য পান, তত দিনে তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে যায়। এর আগে তিনি তিনবার অন্যান্য অভিযাত্রীর অধীনে আমেরিকা যান। তৃতীয়বারে তিনি পানামা সিটির মেয়র ও ম্যাজিস্ট্রেট হন। সেখান থেকে তলেদোয় ফিরে তিনি আরো সামনে অভিযানের জন্য রাজা প্রথম চার্লসের অনুমোদন প্রার্থনা করেন। রাজা তখন ইতালি যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এজন্য তিনি বিষয়টি রানী ইসাবেলার (স্পেনের নয়, পর্তুগালের) বিবেচনায় ছেড়ে দেন। রানী ইসাবেলা ফ্রান্সিসকো পিজারোকে পানামা থেকে সামনে অভিযানের অনুমতি দেন।
১৫৩২ সাল নাগাদ পিজারো তার দলবলসহ তুম্বেস এলাকায় পৌঁছান। এ দলে ছিলেন ১৮০ জন সদস্য, ২৭টি ঘোড়া ও তিনটি জাহাজ। তাদের টার্গেট ছিল ইনকা সাম্রাজ্য। বিরাট এ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল আন্দেজ পর্বতের পাশঘেঁষে একুয়েডর থেকে আর্জেন্টিনা ও পেরুর উপকূল থেকে অ্যামাজন উপত্যকার খাদ পর্যন্ত। ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা ইউরোপীয়দের ছোট দলটিকে দেখে এক মুহূর্তের জন্যও তাদের ক্রূরতা কল্পনা করতে পারেননি। তিনি ‘দূর দেশের মানুষকে’ স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলেন। নিজের সৈন্যদের তিনি শহরের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রাম করতে বলেন। ফ্রান্সিসকো পিজারো ও তার সঙ্গীরা আতাহুয়ালপার মুখোমুখি হন। তাদের সঙ্গী ও পেরুর আর্চবিশপ ভিসেন্তে ভেলভার্দে আতাহুয়ালপাকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বলেন। ইনকা সম্রাট বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। ধর্মগ্রহণের প্রস্তাবে তার প্রত্যুত্তর না পেয়ে স্প্যানিশরা ‘অধার্মিকদের’ আক্রমণ করে। ইনকারা এর আগে ঘোড়া দেখেনি। সম্রাটের দেহরক্ষীদের কাছে ছোট ছোরার চেয়ে কার্যকর কোনো অস্ত্রও ছিল না। অতর্কিত এ আক্রমণ তারা কল্পনা করেনি। দুপক্ষের সাক্ষাতের জায়গাটি মুহূর্তেই রক্তের নদীতে পরিণত হয়। আতাহুয়ালপাকে বন্দি করে ইউরোপীয়রা মুক্তিপণ দাবি করে। ইনকা সম্রাট যা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তা এ লুটেরাদের কল্পনারও বাইরে ছিল।
ফ্রান্সিসকো পিজারোর ব্যক্তিগত সচিব ফ্রান্সিসকো দো জেরেস জানিয়েছেন, আতাহুয়ালপা মুক্তিপণ হিসেবে ২২ ফুট দীর্ঘ ও ১৭ ফুট চওড়া একটি ঘরভর্তি স্বর্ণ দেয়ার প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে স্বর্ণের দ্বিগুণ পরিমাণ রৌপ্য দেয়ারও প্রস্তাব করেন তিনি। ১৫৩৩ সালের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত নয়টি চুল্লিতে মুক্তিপণের স্বর্ণ গলানো হয়। এরপর সেগুলো জাহাজ বোঝাই করে স্পেনে নিয়ে আসা হয়।
মুক্তিপণ আদায় হওয়ার পর ফ্রান্সিসকো পিজারো আতাহুয়ালপাকে হত্যা করেন। এরপর স্প্যানিশরা তার সাম্রাজ্য লুট শুরু করে। এত বেশি পরিমাণ স্বর্ণ সেবার এসেছিল যে, স্প্যানিশদের অনেকে ধাতুটি ওজন করার তোয়াক্কা করতেন না। তারা স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে স্বর্ণ লেনদেন করতেন। স্বর্ণের পাশাপাশি এসেছিল বিপুল পরিমাণ রুপা, রত্নপাথর এবং ইনকা ও আজটেক সাম্রাজ্যের মূল্যবান কারুশিল্পসামগ্রী, তৈজষপত্র ইত্যাদি।
জন ক্যাম্পফনারের দ্য রিচ অবলম্বনে সাঈদ হাসান
পাঠকের মতামত