বিশেষ সংখ্যা/উন্নয়ন অমনিবাস ২
71 Shares

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ক’জন নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, স্বাধীনতার পর মোট কত শতাংশ সময় বাংলাদেশ নারী শাসিত ছিল, এর সঙ্গে যারা নারী জাগরণ ও নারীর ক্ষমতায়নের সম্পর্ক খুঁজছেন, তারা অবশ্যই ভুল করছেন।
গবেষকরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, ফিলিপাইনে সরকারপ্রধানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে অনুরূপ বিশিষ্টজনের কন্যা কিংবা স্ত্রী হতে হয়েছে। পিতৃহীনতা ও বৈধব্য এক্ষেত্রে তাদের রাজনীতিতে টেনে আনতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তারা তখনই রাজনীতির মঞ্চে এসেছেন, যখন পার্টি ধরে রাখতে তাদের চেয়ে উত্তম বিকল্প আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা অবশ্যই কীর্তিখ্যাত, কিন্তু কেউই ক্ষুধার্ত ও নিপীড়িত প্রান্তবর্তী নারীর প্রতিনিধিত্ব করেন না।
চোখ-কান খোলা, মাঠে-ময়দানে কাজ করা একজন নাগরিক হিসেবে আমি দেখেছি আশির দশক থেকে প্রান্তবর্তী নারী উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। একজনকে অনুসরণ করে আরেকজন, তারপর আরেকজন উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেতে শুরু করেছেন।
সে সময় গ্রামের দরিদ্র ও ছিন্নমূল নারীর সামনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সহজ ব্যাখ্যা এবং তাদের এ সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে বেরোনোর বক্তৃতা যারা শুনিয়েছেন, তারা আরো সহজ এবং আরো সরল ব্যাখ্যা শুনে এসেছেন সেই নারীদের কাছ থেকে।
আমিও যমুনা নদীর ভাঙনে সর্বস্বান্ত নারীর মুখে শুনেছি: কিসের পিতৃতন্ত্রের বকবক শুরু করেছেন? সংসারে যার কাছে টাকা থাকে, তার নামই পিতা, তার নামই স্বামী।
নারীকে তুলে আনতে রাষ্ট্রের কমিটমেন্টের কথাও কেউ কেউ বলেছেন, শিক্ষিত নারীর সিভিল সার্ভিসে যোগদানের প্রশ্নে রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো প্রতিশ্রুতি থাকলে তার সুফল পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু প্রান্তবর্তীর কাছে এসব প্রতিশ্রুতি অর্থহীন। তার প্রাথমিক প্রয়োজন কিছু টাকা। আমি যে নারীর কথা বলছি, পিতৃমাতৃসূত্রে তার কিছুই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া তার মা-বাবাও তারই মতো নিঃস্ব। তার হাতে আসতে হবে ‘কামাইয়ের টাকা’, ‘শ্রমবেচা টাকা’।
হাতে টাকা এলেই কি তা হাতে থাকবে? স্বামী নিয়ে নেবে না?
এ প্রশ্নের মোকাবেলা করেই নারী আশির দশক অতিক্রম করেছেন। নারীর কামাই স্বামী নিয়েছে, বাবা নিয়েছে, ছেলে নিয়েছে, এটা মিথ্যে নয়। এ নারী স্বামী, বাবা ও ছেলের কাছে খরচের হিসাব চেয়েছেন, এটাও অসত্য নয়। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে— তখন স্বামী, বাবা ও ছেলে টাকা দেয়ার জন্য হুকুম দিত, এখন টাকা দেয়ার জন্য তোষামোদ করে। এখন টাকা দেয়া না-দেয়া নির্ভর করছে সেই নারীর ইচ্ছের ওপর; স্বামী, বাবা ও ছেলের ওপর কতটুকু আস্থা তার ওপর।
আমি মনে করি, এটি অত্যন্ত বড় একটি পরিবর্তন। এ ধরনের পরিবর্তন ঘটতে ইউরোপেও শত বছর লেগেছে। আশির দশকের বাংলাদেশী প্রান্তবর্তী নারীর যে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে, সে দেয়ালেই ঠেস দিয়ে মূলত গ্রামীণ ব্যাংকের হাত ধরে জীবন ও বাস্তবতাকে মোকাবেলাকে করেছেন। সহযোগী আরো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছিল কিন্তু মূল নেতৃত্বে ছিল অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক।
দুই
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক আমাদের ঈর্ষাসঞ্জাত ‘হেইট ক্যাম্পেইন’-এর শিকার হয়েছেন, সমালোচনার ঝড় উঠেছে, আমরা প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছি। এক ধরনের রাজনীতিকীকরণও হয়েছে।
আমি যে সময়ের কথা লিখছি, সেই আশির দশকেও বাম ও ডান ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের যেসব সমালোচনা আমার কানে এসেছে, তার কয়েকটি তুলে ধরছি:
ক. ইউনূস পশ্চিমের ধামাধরা, সিআইএর এজেন্ট। সমাজতন্ত্রের শত্রু। বিপ্লব ঠেকাতে ধনতান্ত্রিক বিশ্বের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কাজ করছেন। বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছেন।
খ. কোনো রকমে বেঁচে থাকার একটি ফাঁদ তৈরি করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। এতে ধরা পড়া পরিবারগুলো কখনো দারিদ্র্যরেখার উপরে উঠতে পারবে না। তাদের বিপ্লবী সত্তা মরে যাবে, তারা দারিদ্র্য-দাসত্ব মেনে জীবন কাটিয়ে দেবে।
গ. সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুগ্রহপুষ্ট এনজিওগুলোকে গ্রামেগঞ্জে ঢুকতে উৎসাহিত করবে। তারা মানুষের নৈতিক শক্তি ধ্বংস করে দেবে।
ঘ. গ্রামীণ ব্যাংক একটি মহাসুদখোর প্রতিষ্ঠান। সুদের হার কৃষি ব্যাংকের হারের চেয়ে অনেক বেশি। এটি ছদ্মবেশী মহাজনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ঙ. গ্রামীণ একটি ‘হারাম ব্যবসায়ের’ প্রতিষ্ঠান। ইসলাম ধর্মের ক্ষতি করার জন্য ইহুদি-নাসারা চক্রের এজেন্ডা দিয়ে গ্রামীণকে মাঠে ছাড়া হয়েছে।
চ. নারীকে বেপর্দা করা হয়েছে এবং বেশরিয়তি কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে।
ছ. নারীকে স্বামী ও পিতার অবাধ্য হতে প্ররোচনা দিয়ে সংসার ভাঙার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জ. বিনা সুদে টাকা এনে মহাজনি ব্যবসায় টাকা লগ্নির অনৈতিক কাজ করছে গ্রামীণ ব্যাংক।
সে সময় অর্থনীতিবিদ, আমলা ও উন্নয়ন অনুশীলনকারীরা যে সমালোচনা করেছেন, তার কয়েকটি আমার নিজের একটি অভিসন্দর্ভ থেকে উদ্ধৃত করছি:
ক. স্বল্পমেয়াদে গ্রামীণ ব্যাংক কিছু সাফল্য দেখাতে পারলেও স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনায় অঙ্গীভূত না হওয়ার কারণে এবং আন্তঃবিভাগীয় নেটওয়ার্কে সংযুক্ত না হওয়ার কারণে তা টেকসই হবে না।
খ. দরিদ্র নারী-পুরুষের একাংশ মাত্র গ্রামীণ ব্যাংক কার্যক্রমের আওতায় এসেছে, কাজেই দারিদ্র্য পরিস্থিতি বদলাবে না।
গ. দরিদ্রজনের সঞ্চয় প্রবণতা কম হওয়ায় মূলধন সৃষ্টি তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। অন্যদিকে হাতে টাকা আসায় ভোগ্যপণ্যের দিকে তাদের ঝোঁক বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে।
ঘ. অসম সমাজ কাঠামো ধরে রেখে প্রান্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।
ঙ. গ্রামীণ ব্যাংক উৎপাদন নয়, কেবল বাণিজ্য বৃদ্ধি করছে।
চ. ‘সাবসিডি’প্রাপ্ত গ্রামীণ মূলধন প্রত্যাহার করা হলে প্রতিষ্ঠানটি ধসে পড়বে।
ছ. ক্ষুদ্রঋণের অংক যখন বড় ঋণে পরিণত হবে, গ্রামীণ ব্যাংক কর্মকর্তারা সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠবেন।
জ. গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের মূল প্রবণতা এক খণ্ড জমি কেনা, অর্থাৎ ঋণের অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে আটকে যাচ্ছে।
ঝ. গ্রামীণ ব্যাংকের উপকারভোগীদের তৈরি সব পণ্য কিনে নেয়ার মতো সম্প্রসারিত বাজার সৃষ্টি হয়নি।
ঞ. গ্রামীণ ব্যাংকের ক্যারিশমাটিক প্রতিষ্ঠাতার অবর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে পড়বে।
যারা দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম অনুসরণ করছেন, দুই ধরনের সমালোচনার সঙ্গে নিজেদের পর্যবেক্ষণ মিলিয়ে দেখতে পারেন।
তিন
আমি আশির দশকের গ্রামীণ ব্যাংককে দেখেছি মূলত প্রান্তিক নারীর জাগরণের একটি প্লাটফর্ম হিসেবে। শুরুর দিকে ১৯৮২ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের উপকারভোগী কিংবা ঋণগ্রহীতা পুরুষ ও নারীর সংখ্যা ছিল সমান। গ্রামীণ ব্যাংক তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ফোকাস দৃষ্টীকরণ করে নারীর ওপর। দশকের শেষে নারীর সংখ্যা পুরুষের ১০ গুণ ছাড়িয়ে যায়। ক্রমে গ্রামীণ ব্যাংক হয়ে ওঠে নারীর ব্যাংক।
আশির দশকে যেসব নারী গ্রামীণ ঋণগ্রহীতা হিসেবে নাম লেখান, মোটামুটিভাবে এক দশক পর তারা নিজেদের অবস্থার কতটা পরিবর্তন করতে পেরেছেন, ১৯৯৪ সালে আমি একটি সমীক্ষা চালাই। ঋণগ্রহীতা কয়েকজনের সঙ্গে বসে কাগজ-কলম নিয়ে হিসাব করতে বসি।
দু-একটি উদাহরণ আমার বক্তব্যকে স্পষ্ট করবে।
বেলতৈল গ্রামের জরিমন নয়, আমি টাঙ্গাইলের রক্ষিত বেলতার সুমারি বেগমের কাছে যাই। শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচারিত, স্বামী পরিত্যক্ত বিপন্ন এ নারী তিন কন্যাসন্তান নিয়ে প্রায় অনাহারেই দিন কাটাচ্ছিলেন। এ সময় বিনা জামানতে ৭০০ টাকা ঋণ পাওয়ার মতো একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা তাকে বিহ্বল করে দেয়। তিনি ৬০০ টাকায় একটি বাছুর এবং ১০০ টাকায় পাঁচটি হাঁস কেনেন। তার আগে অনেক চেষ্টা করে পাঁচজনের একটি দল গড়েন। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিতে দলভুক্ত হওয়ার অপরাধে তার দলের ধুকুরিকে হত্যা করার জন্য তার স্বামী ছুটে আসে। তাকে কোপও দেয়। আহত ধুকুরি তালাক দেয়।
সুমারির নিজের উদ্যোগ ছিল, গ্রামীণের নিবিড় পর্যবেক্ষণাধীন ঋণ তাকে সহায়তা করেছে। তার কাছ থেকে সম্পদের যে বিবরণ আমি পেয়েছি, ১৯৮০-তে গ্রামীণ ব্যাংকভুক্ত হওয়ার আগে তিনটি মুরগিসহ তার সম্পদের মোট মূল্য ছিল ৩০০ টাকা, ১৯৯৪-এর মাঝামাঝি সময় ১৩ হাজার টাকার গ্রামীণ ব্যাংকঋণ বাদ দিয়ে তার সম্পদের অর্থমূল্য ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। গ্রামীণ ব্যাংক কর্মকর্তার আগোচরে তিনি ৩০ হাজার টাকা একটি সরকারি ব্যাংকে রেখেছেন।
তিনি কত টাকার মালিক হয়েছেন, আমার কাছে এর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, তিনি আত্মবিশ্বাসী একজন নারীতে পরিণত হয়েছেন। তিন মেয়েকেই স্কুলে পাঠাচ্ছেন। তার মতো একদা অসহায় নারীদের নিজের জীবনের গল্প শুনিয়ে উৎসাহিত করছেন এবং বলছেন— স্বামী থাকলে ভালো, না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। হাতে টাকা থাকা থাকলে এটা স্বামীর চেয়ে বেশি কাজে লাগে।
এটা মিথ্যে নয় যে সব নারীই তার মতো উদ্যোগী নন। তার পরও জামানতবিহীন ঋণের আহ্বান তো তাকে ঘর থেকে বের করে এনেছে। পুরুষের অন্যায় আবদারকে প্রত্যাখ্যান করতে শিখিয়েছে, ব্যাংকের চাকুরেদের সঙ্গে সংকোচ ঝেড়ে কথা বলতে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার কাছে নারী জাগরণ মানে কখনো নারীর প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হওয়া নয়, আমর কাছে নারী জাগরণ মানে প্রান্তবর্তী নারীর নিজের অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করে নিজের চেষ্টায় উন্নততর অবস্থানে যাওয়া। সুমারি বললেন, তার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হওয়ায় একদা তাকে মারপিট করে, পরিত্যক্ত করে রেখে যাওয়া স্বামী আবার তার কাছে ফিরে আসতে চাইছে।
এ স্বামী আরেকটি বিয়েও করে, সে ঘরে একটি সন্তানও আছে। আমি জিজ্ঞেস করি, কী আর সিদ্ধান্ত!
তিনি যা বলেন, তা আমাকে আরো বিস্মিত করে। তিনি বলেন, সেই ঘরের বাচ্চাটার কী দোষ? সে তো নিষ্পাপ। আর সেই মহিলাও (সতিন) তো আমার মতোই একজন অসহায় মানুষ, আমি যদি তাদের দেখাশোনা করতে পারি, আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন।
আর আপানার সেই স্বামী?
তিনি বলেন, মানুষটা এখন অসুস্থ। আমাকে ছেড়ে গিয়ে নিজেও ভুগেছে। তাছাড়া আমার মেয়েদের বিয়ে দেয়ার সময় বাপের পরিচয়ে একজন দাঁড়ালে উপকারই হবে।
শেষ পর্যন্ত কিছু শর্ত দিয়ে তাকে যে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই স্বামীকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছেন।
সুমারির মতো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া আরো কয়েকজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাদের কেউ ঋণখেলাপি নন, তাদের অনেকেই ‘সংসারের স্বামী’তে পরিণত হয়েছেন। ‘হাজব্যান্ডিং’-এর জন্য পুরুষ হওয়া অনিবার্য নয়। এ কথাটাই সত্য, হাতে টাকা থাকলে, টাকা খরচের স্বাধীনতা থাকলে সে-ই স্বামী।
আশির দশকে হাঁকডাক করে, শাহবাগ চত্বর দখল করে, রাস্তাঘাট অচল করে, চোঙা-ফোঁকা বক্তৃতা দিয়ে আন্দোলন করে জাগরণ ঘটেনি, এটি ঘটেছে নীরবে। বিজলিবাতি শাসিত এলাকার বাইরে, প্রান্তজনের সংসারে। এটি নীরব বিপ্লব, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন, কোনো বড় মুখ প্রতিশ্রুতি এটা করেনি। একটুখানি সহায়তা পাওয়ায় গ্রামের বিপন্ন নারীরাই নিজেদের অবস্থানের পরিবর্তন করতে পেরেছেন।
গ্রামীণ উদ্যোগ এ জাগরণের প্রধান হাতিয়ার।
চার
সত্তরের দশকের শেষ পর্বে অর্থনীতির অধ্যাপক ইউনূস চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে সামান্য মূলধন নিয়ে পরীক্ষামূলক যে গবেষণা প্রকল্পটি হাতে নেন, তার উদ্দেশ্য ছিল: (ক) গ্রামীণ হতদরিদ্রদের কাছে ব্যাংকের কিছু সেবা পৌঁছে দেয়া (খ) মহাজনের শোষণ থেকে তাদের মুক্ত করা (গ) আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা (ঘ) পারস্পরিক সহযোগিতায় গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক আদলে দাঁড় করানো এবং (ঙ) ‘কম আয়, কম সঞ্চয়, কম বিনিয়োগ’ এ দুষ্টচক্র পাল্টাতে চেষ্টা করা।
গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে এটা স্পষ্ট হয়, ক্ষুদ্রঋণের উত্তম গ্রহীতা নারী, পুরুষ নয়। শুরুতে যেখানে নারী সদস্য ছিলেন ৪ দশমিক ২ শতাংশ, ১৯৯২ সালে পুরুষ সদস্যের হিসাবটা একেবারে পাল্টে যায়। ততদিনে ঋণগ্রহীতার ৯৬ শতাংশই নারী, মাত্র ৪ শতাংশ পুরুষ।
ডায়ান এলসন তার ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট: ইটস এফেক্ট অন উইমেন’-এ দেখিয়েছেন, রাষ্ট্র জেন্ডারনিরপেক্ষ যত কর্মসূচিই গ্রহণ করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের গাঠনিক কারণে তা নারীকে আরো প্রান্তে নিয়ে যায়। তাদের অধস্তনতা আরো বেড়ে যায়, যদিও বাজার অর্থনীতি বাজারে পৌঁছার পর নারী ও পুরুষের কেনো বিভেদ বিবেচনা করে না। এএম গোয়েটজ ও আর এস গুপ্ত দেখিয়েছেন, বহু ধরনের আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহক হিসেবে বাংলাদেশের দরিদ্র নারী যে সাফল্য দেখিয়েছেন, তা তাদের এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি।
আশির দশকে সীমিত হলেও গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের দরিদ্র নারীকে বাজারের পথ দেখিয়েছে, বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে সাহায্য করেছে।
উৎপাদনকারী হিসেবেই হোক কি শ্রমিক হিসেবে, বাজারে প্রবেশাধিকার পেলে নারীর হাতে কিছু নগদ অর্থ আসে, তাতে স্বামীর ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমে, নারী আর্থিক মূল্য (প্রাইস নয়, ভ্যালু) বাড়ে, বাড়িতে এবং বাড়ির বাইরে দরকষাকষির ক্ষমতাও বেড়ে যায়— সব মিলিয়ে নারীর মর্যাদা বাড়ে।
আশির দশকে মাহবুব হোসেনের একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে, গ্রামীণের নারীদের ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ আগে কখনো কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফল হাতে পায়নি, তাদের কোনো আয় ছিল না।
‘আয় করবে পুরুষ’— এ মিথটিকে গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে দিতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, একই ধরনের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী পুরুষের তুলনায় তারা ৩৭ শতাংশ বেশি আয়ও করেছেন। প্রতি ইউনিট ঋণের উৎপাদনশীলতা নারীর বেলাতেই বেশি।
আমার কাছে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, গ্রামীণ সাহচর্য এবং আয় তাদের প্রজনন-পছন্দ-রিপ্রডাক্টিভ চয়েস, অনেকটাই প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রজননক্ষম বয়সের নারী কেবল নিজেই জন্মশাসন মানছেন না, অনেক স্বামীকেই বাধ্য করছেন। এগুলো আজ খুব সাধারণ বিষয় বলে মনে হলেও গ্রামের সমাজ কাঠামোতে ও গোঁড়ামিপূর্ণ অনুশাসন ভেঙে জন্মনিয়ন্ত্রণ করে পরিকল্পিত পরিবারের কথা বলতে পারাটাই ছিল বৈপ্লবিক কাজ।
ড. ইউনূসকে বিরাগ থেকে, অসন্তুষ্টি থেকে যেভাবেই চিত্রিত করা হোক না কেন, এ দেশের নারীমুক্তির (যতটুকই হয়ে থাকুক) ইতিহাস লিখতে গেলে তাকে উপেক্ষা করা অজ্ঞানতা ও বিদ্বেষপ্রসূত বলেই বিবেচিত হবে। ডেভিড হিউম দেখিয়েছেন, পৃথিবীতে বাংলাদেশের একটিই ‘আইকনিক মডেল’, তা হলো গ্রামীণ ব্যাংক। পৃথিবীর অনেক দেশে বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক মডেল প্রতিস্থাপিত হয়েছে। দরিদ্র অসহায় নারী যে দারিদ্র্যের বৃত্ত ভাঙতে জানেন, অসহায়ত্বের যাতনাকে শক্তিতে পরিণত করতে পারেন, তা তো বাংলাদেশ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণে তৈরি বাড়ির কোনো নারী মালিকই ঋণের দায়ে আবদ্ধ নন; কেবল উৎপাদনশীল খাতেই নয়, গৃহ নির্মাণের মতো অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণের টাকা পরিশোধও যে সম্ভব, তাও প্রমাণিত।
এটা মিথ্যে নয় যে ক্ষুদ্রঋণের অর্থে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যাবে না, এতে শিল্প বিপ্লবও ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু শিল্প বিপ্লব ঘটানোর জন্য যারা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন (এদের মধ্যে নারী ঋণগ্রহীতা রয়েছেন), খেলাপি হয়েছেন, আত্মসাৎ করেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্র দাঁড়াচ্ছে তাদেরই পক্ষে।
পাশ্চাত্য মনে করে, আশির দশক সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম-উত্তরকাল। ফাস্ট ওয়েভ ফেমিনিজমে মূল বিষয় ছিল নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং লিঙ্গসমতার পথে বাধা দূর করা।
ষাটের দশকের শুরু থেকে প্রায় দুই দশকব্যাপী সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম যেসব বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে— নারীর প্রজনন অধিকার, আইনি অসমতা, পারিবারিক সহিংসতা ধর্ষণ-নির্যাতন, তালাক আইন ও কাস্টডি আইনে নারীর সুরক্ষা ইত্যাদি। এ সময় পশ্চিমের নারী বলতে পেরেছেন, ‘মাছের জন্য বাইসাইকেল যতটা প্রয়োজন, পুরুষ নারীর জন্য ঠিক ততটাই প্রয়োজন।’
আশির দশকে পশ্চিমে এ কথাও প্রতিধ্বনিত হয়েছে, নারীর মুক্তি মানে অর্থনৈতিক মুক্তি।
পুরো মুক্ত করতে না পারলেও একদা অনতিক্রান্ত বৃত্ত ভেঙে গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশে সে কাজটাই শুরু করেছে সেই আশির দশকে।
১৯১৪ সালে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে এলিস হকিন্স সাইকেল চালিয়ে ব্রিটেনকে জাগিয়েছেন। বাংলাদেশের গ্রামে নারীর হাতে সাইকেলের স্টিয়ারিংও আছে— সেই আশির দশক থেকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সাবেক সরকারি ও বেসরকারি বিমান কর্মকর্তা